রবিবাসরীয় গল্প
শেষ পারিজাত
বাবার কথা শুনে কোনও দিন ঠকেনি ঝুমুর। এক বারই বাবার অবাধ্য হয়েছিল, কলেজে ঢোকার সময় অনার্স নিল না। তার ফলে খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এম এ-টা আর পড়া হল না ওর। ঝুমুর বাবাকে বলল, ‘আমি কম্পিউটারের ওপর একটা কোর্স করি?’
‘দাঁড়া, তোর বিয়ে দিয়ে দেব। তার পর যা হয় করিস।’
‘বিয়ে-বিয়ে করছ কেন বলো তো? আমি সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে পারব না।’
ঝুমুরের মা বলল, ‘সে তোকে বসতে হবেও না। তোর বাবা তোর পাত্র ঠিক করে ফেলেছে।’
‘সে কী? কে সে?’
‘এ বার দিল্লি যাওয়ার সময় তোর বাবার সঙ্গে ট্রেনে একটি ছেলের আলাপ হয়েছে। দারুণ নাকি ছেলে, তোর বাবা একেবারে মুগ্ধ।’
ঝুমুরের বাবা উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘এমন ভাল ছেলে দেখা যায় না। যেমন ব্যবহার, তেমন স্বভাব। পড়াশোনাতেও খুব ভাল। ইকনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। গোল্ড মেডেলিস্ট।’
‘তার পর? অমনি তুমি আমার জন্য সব ভেবে ফেললে?’ ঝুমুর হাসতে হাসতে বলল।
‘ভাবব না? আফটার অল আমি এক জন মেয়ের বাবা। নাগালের মধ্যে অমন সুপাত্র হাতছাড়া করা যায়?’
‘তুমি কি সত্যিই বিয়ে পাকা করে ফেলেছ?’ ঝুমুরের মায়ের গলায় উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা।
‘হ্যাঁ, অলমোস্ট। জানি, ঝুম পাত্রপক্ষের সামনে বসতে চায় না। ও দিকে স্বর্ণাভ বিনা দেখাতেই রাজি হয়ে গেল। বলে কিনা, আপনার মেয়ে? আলাদা করে আর দেখার দরকার নেই। তার পর ঝুমুরের ছবি দেখে তো কাত।’
‘আমার ছবি? তুমি ওকে দিয়ে দিলে বাবা? দিস ইজ নট ফেয়ার।’
‘আমাকে তুই বিশ্বাস করিস না? ভরসা নেই আমার ওপর?’
‘না, আমি তা বলছি না।’ মিইয়ে গেল ঝুমুর। তার পর একটু ভেবেচিন্তে বলল, ‘সে না হয়, না দেখে বা ছবি দেখে রাজি হয়ে গিয়েছে। তার বাড়ির লোক? তারা দেখতে চাইবে না?’
‘না। স্বর্ণাভ বলেছে, আমার বাবা নেই। থাকার মধ্যে জেঠা-জেঠি আর মা। আপনি নিজে গিয়ে একটু বুঝিয়ে বললেই হবে। মা এমনিতেই কোথাও যেতে চান না। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে নেব।’
‘ও, তাই বুঝি?’ ব্যবস্থাটা ঝুমুরের পছন্দ হল। বাবাকে জিজ্ঞাসা করল মজার গলায়, ‘তোমার এই সুপাত্রের বাড়ি কোথায়?’
ঝুমুরের মা বলল, ‘ছেলের বাড়ি কাঁচরাপাড়ায় কিন্তু সে...’
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝুমুর ছিটকে উঠল, ‘আমি কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে থাকব না কিছুতেই।
হো হো করে হেসে উঠল ঝুমুরের বাবা, ‘শোন শোন, তোকে কাঁচরাপাড়ায় থাকতে হবে না। ছেলেটি সোনারপুরে পোস্টেড। ওখানেই অফিস কোয়ার্টার। একেবারে নিজের মতো থাকবি। নো ঝঞ্ঝাট, নো ঝামেলা।’ বাবার কথার ধরন দেখে হেসে ফেলল ঝুমুর। ঝুমুরের মা বলল, ‘দেনা-পাওনার কথা-টথাও তো বলতে হবে।’
ঝুমুর চমকে তাকাল, তার বিয়ের জন্য দেনাপাওনার হিসেব? ব্যাপারটা যে ভীষণ অপছন্দ তার। হেসে উঠল বাবা, ‘গিন্নি, কিচ্ছু চায় না ওরা।’
‘সত্যি বলছ?’ মায়ের বিস্ময়ের সঙ্গে পুলক মিশে গেল।
‘তবে আর বলছি কী? এত ভাল ছেলে খুঁজতে বেরোলেও পেতাম না। বোধ হয় ঈশ্বরই মিলিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটি দিল্লিতে কাজে গিয়েছে। থাকবে দু’মাস মতো। আমি সেখানেও খোঁজ নিয়েছি। সোনারপুরেও।’
ঝুমুর মাথা নিচু করে, লাজুক স্বরে বলল, ‘বাবা, স্বর্ণাভকে দেখতে কেমন?’
‘দেখাটাই কি সব? আসল তো হল ভেতরটা। সেখানটা আমি দেখেছি ঝুম, একেবারে খাঁটি সোনা। তবে হ্যাঁ, বেঁটে নয়, মোটা নয়, ভুঁড়িটুড়ি নেই। স্বাস্থ্য ভাল। পরিশ্রমী। কথা কম বলে একটু। তা তো ভালই, দাম্পত্য কলহ কম হবে।’
ঝুমুর আর কী বলবে? ও মুখ নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পেছন থেকে বাবা ডাকল, ‘শোন ঝুম, এ দিকে আয়। তোকে দুটো জিনিস দিচ্ছি। রেখে দে।’ এই বলে বাবা একটা ফটোগ্রাফ দিল, এই-ই নিশ্চয়ই স্বর্ণাভ। আর একটা ফোন নম্বর।
‘বাবা, আমি কী করে...
‘আমার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়, আমি গ্রিন সিগনাল দিলে ও নিজেই ফোন করবে। তোকে করতে হবে না।’

ছবি দেখে পুরো মানুষটাকে বোঝা যায় না তবে একটা আদল বোঝা যায়। গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি লম্বা চেহারার পুরুষ। মুখটি যেহেতু ক্লোজ আপে নেই, তাই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তার মুখশ্রী।
ঝুমুর অপেক্ষা করছে। ফোন নাকি করবে স্বর্ণাভ! একটা গোটা দিন চলে গেল। আর একটা সম্পূর্ণ রাত্রি। উৎকর্ণ হয়ে আছে ঝুমুর। তারও পর দিন সকালবেলায়, প্রায় ভোরই বলা যেতে পারে, ঝুমুরের সেল ফোন বেজে উঠল। সেই নম্বর, সুতরাং ওর বুকের মধ্যে ধড়াস করছে, কিন্তু সেটা বিন্দুমাত্র প্রকাশ না করে বেশ নিরীহ গলায় ঝুমুর বলল, ‘হ্যালো।’
‘আমি স্বর্ণাভ বলছি, আপনি কি ঝুমুর বলছেন?’
‘হ্যাঁ বলছি।’
‘আপনার বাবার কাছ থেকে আমার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন?’
‘হ্যাঁ শুনেছি। সবই শুনেছি।’
‘এত সকালে ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত। আমার কাল রাতেই আপনাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বেশি রাতে করলে আপনি যদি কিছু মনে করেন, তাই আর... আপনি শুনছেন তো?’
খুব হাসি পাচ্ছে ঝুমের। ভদ্রলোক তো দেখছি বিনয়ের অবতার। ও যথেষ্ট শান্ত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, শুনছি তো।’
‘আমি আপনার ছবি দেখেছি, তা ছাড়া আপনার বাবাকেও দেখেছি। আমার আর আলাদা করে দেখার দরকার নেই, কিন্তু আপনি আমাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন?’
‘বাবার পছন্দের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। তা ছাড়া এক দিন দেখলেই কি মানুষকে বোঝা যায়? বাবা বলেন, মানুষের ভেতরের রূপটাই আসল।’
‘হ্যাঁ সে তো ঠিকই বলেন। উনি এত ভাল মানুষ। কিন্তু আমার মনে হয়...’
‘কী মনে হয়? তাঁর মেয়ে এত ভাল নাও হতে পারে?’
‘না, না, কী যে বলেন? তা কেন ভাবব। ছিঃ ছিঃ।’ স্বর্ণাভর তোতলানো অবস্থা শুনে ঝুমুর হেসে ফেলল, ‘আপনি তো আমার ছবি দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি। আপনি তো খুবই সুন্দরী কিন্তু জানেন, আমাকে দেখতে মোটেই ভাল নয়। সামনা-সামনি দেখলে আপনি আমাকে কিছুতেই পছন্দ করতেন না।’
‘সেটা সামনাসামনি দেখেই বলা যাবে। এখন ছাড়ছি।’ ঝুমুর ইচ্ছে করে ফোন ছেড়ে দিল। প্রথম দিন কি এর চেয়ে বেশি কথা বলা উচিত? স্বর্ণাভর গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি, সবই ভাল লাগল ঝুমুরের। বাবার কথা শুনে তো ও কখনও ঠকেনি। জীবনের সবচেয়ে বড় বাজিটা না হয় ও বাবার কথার ওপর ভরসা করেই খেলল।
ঝুমুরের সঙ্গে স্বর্ণাভর আরও কয়েক দিন ফোনে কথা হল। কোর্টশিপ যে খুব জমল, এ কথা বলা যাবে না, তবে ছেলেটির বাচনভঙ্গি ভারী সুন্দর। কম কথা বলে কিন্তু যেটুকু বলে সুন্দর করে বলে। ঝুমুরের আগ্রহ তাতে বাড়ল বই কমল না। আর স্বর্ণাভ তো এক দিন সলজ্জ কণ্ঠে বলেই ফেলল, ‘আমি শুধু সেই দিনটির অপেক্ষাতেই আছি।’ ওটা তো ঝুমুরেরও মনের কথা কিন্তু মেয়েদের মনের কথা সব প্রকাশ করতে নেই।

পানপাতায় মুখ ঢেকে আছে ঝুমুর। পিঁড়ি ধরে ঘোরানো হচ্ছে ওকে। ক’পাক হল? প্রশ্ন উঠছে, আর সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠছে সবাই, চার পাক, পাঁচ পাক... ঝুমুরের বুকের মধ্যে ঘণ্টা বাজছে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ উঠছে। সামনাসামনি দু’জনে। এ বার শুভদৃষ্টি আর মালা বদল। পানপাতা সরিয়ে নাও গো মেয়ে, তাকাও বরের দিকে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে। ঝুমুর তাকাতেই পারছে না। কে যেন ওর চিবুক ধরে উঁচু করে দিল মুখটা। সুঠাম স্বাস্থ্য মানুষটার সন্দেহ নেই। দৃষ্টিটা মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওপর দিকে উঠছে। অনেকটাই লম্বা, তাই চোখের দৃষ্টি একটু ওপরেই স্থাপিত হল। চারি চোখের মিলন। উলুধ্বনি আর হুল্লোড়ে ভেঙে পড়ছে চার দিক। ঝুমুর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এত কালো গায়ের রং স্বর্ণাভ নামের কোনও ছেলের হতে পারে? তার পর দু’গালে বসন্তের দাগ। সব মিলিয়ে কুশ্রীই বলা চলে। বাবা তার সঙ্গে এমন করল? বাবা জানে না, কালো গায়ের রঙের লোকের ওপর ঝুমুরের কী ভীষণ অ্যালার্জি! একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাণের বন্ধু বীথি। সে কোনও হুল্লোড়ে যোগ দেয়নি। বীথির দিকে এক মুহূর্তের জন্য নজর পড়ল ঝুমুরের, বীথির চোখে জল।

ঝুমুরের মা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘কাজটা তুমি ঠিক করোনি। সবাই বলাবলি করছে বাঁদরের গলায় মুক্তোর হার। আমার ঝুমকে ছোটবেলায় সবাই স্নো-হোয়াইট বলত। মেম-পুতুল বলত।’ ঝুমুরের বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল একটু, তার পর রাগত স্বরে বলল, ‘আশ্চর্য। একটা মানুষের বিচার হবে তার গায়ের রং দিয়ে? মেয়েকে বোঝাও একটু।’ বউভাতের দিন মা এক বার ফোন করল, ঝুমুর বলল, ‘কী ব্যাপার, ফোন কীসের জন্য?’ মা ব্যাকুল গলায় বলল, ‘তুই কি আমাদের কোনও দিন ক্ষমা করতে পারবি না ঝুম? ওখানে কি তোর খারাপ লাগছে?’
‘কেন বলো তো? এখানে আমার খুব ভাল লাগছে। এরা সবাই এত ভাল। কত যত্ন করছে আমার।’
‘ও, তোর সুখই আমাদের সুখ। বলছি কী, তোর বাবা একটু কথা বলতে চায়।’
‘আমি একটু ব্যস্ত আছি মা।’
ফোন কেটে দিল ঝুমুর।
প্রীতিভোজ আর অতিথি আপ্যায়ন দিয়ে তো কেটে গেল রাত পর্যন্ত। ঝুমুর ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখল প্লাস্টিক হাসি। যাকে সত্যিই বোধ হয় বলে, মাপা হাসি চাপা কান্না।
কিন্তু রাত গভীর হওয়ার পর হাস্যমুখরা ললনারা তো দু’জনকে এক করে দিয়ে গেল ফুলশয্যার ঘরে। এ বার ঝুমুরের সব স্মার্টনেস তো বস্তাবন্দি হওয়ার মুখে। কিন্তু ঝুমুর হার মানবে না। যতই সে জল ও কুমিরের সঙ্গে একাসনে বসে থাকুক না কেন। সত্যি বলতে কী ঝুমুর ফুলশোভিত পালঙ্কে গেলই না। ও জানলায় দাঁড়িয়ে রইল। পিছন থেকে স্বর্ণাভ এসে ওর কাঁধে আলতো হাত রাখল, ‘আমাকে তোমার একটুও পছন্দ হয়নি না?’ জোরে পিছন ঘুরল ঝুমুর, স্বর্ণাভর হাত পিছলে গেল কাঁধ থেকে, চাপা গলায় একটি শব্দ উচ্চারণ করল ঝুমুর, ‘না।’ বিবর্ণ হয়ে গেল স্বর্ণাভর গলার স্বর, ‘আমি এই ভয়টাই পেয়েছিলাম।’
‘ভয় পেয়েছিলে, নাকি বাবার সঙ্গে মিলে একটা ষড়যন্ত্র করেছিলে আমাকে নিয়ে?’
‘ছিঃ ঝুমুর, আমাকে যা বলো বলো। কিন্তু নিজের বাবার সম্বন্ধে যা তা বোলো না।’
‘কী দিয়ে যে বাবাকে বশ করেছিলে জানি না।’
‘তা হলে?’ স্বর্ণাভর প্রশ্নটা ছোট্ট কিন্তু মোক্ষম।
ঝুমুরও বিরক্তি সামলে অবলীলায় উত্তর দিয়েছিল, ‘তা হলে কী আমি জানি না, তবে আপাতত আমাদের ফুলশয্যা হচ্ছে না।’
দু’মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল স্বর্ণাভ। তার পর আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসল, ‘এখন এ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সিন ক্রিয়েট হবে। তাই রাতটা ঘরে থাকার অনুমতি চেয়ে নিলাম তোমার কাছ থেকে।’
ঝুমুর কী করবে এখন? সং-এর মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি ঘর ছেড়ে দৌড় মারবে? লোকটাকে অসহ্য লাগছে। মাঝরাতে লোকটা কুমির হয়ে যাবে না তো?’ স্বর্ণাভ কী ভাবল, কী বুঝল, সে-ই জানে, নিচু গলায় বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্তে খাটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারো।’
ঝুমুরের খুব ক্লান্তি লাগছিল, ও ধীরে ধীরে খাটে গিয়ে বসল। স্বর্ণাভ বলল, ‘আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে কাটাও। কালই আমরা সোনারপুর যাব। ওখানে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন।’ স্বর্ণাভর কথার দাম আছে। পর দিন সকালেই ওরা সোনারপুরের পথ ধরল। বাড়ি পৌঁছে প্রথমেই স্বর্ণাভ কাজের মাসির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল ঝুমুরের। মাসি সকালে আসে, সারা দিন কাজ করে, রাতের খাবার গুছিয়ে দিয়ে তার পর বাড়ি চলে যায়। বাড়িটা বেশ বড়, পরিচ্ছন্ন। রুচিসম্মত ভাবেই সাজানো। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর। চানটান করে খেয়ে স্বর্ণাভ অফিসে চলে গেল। যাওয়ার সময় ঝুমুরের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে গেল, ‘আমি অফিস যাচ্ছি। বেকার ছুটিগুলো নষ্ট করে আর কী হবে। মাসি রইল, যা দরকার ওকে জানিয়ো।’ ঝুমুর কোনও উত্তর দিল না।
সারা দিন ঝুমুরের একা একাই কেটে গেল। এক বার মা ফোন করল, ফোনে ঝুমুর একটা কথাই বলল, ‘আমি ভাল আছি।’ পরের বারের ফোনটা আর ধরল না। মাসির সঙ্গেও বিশেষ কথা বলল না। রান্নার কথা এক বার জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল, ঝুমুর ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তুমি যা ভাল বোঝো করো।’
রাতে ডাইনিং টেবিলে স্বর্ণাভ আর ঝুমুর মুখোমুখি হল। নীরবে শেষ হল খাওয়া। তার পর পাশাপাশি দু’টি ঘরে দু’জনে ঢুকে গেল। নিঃশব্দে শেষ হল রাত। পরের দিনটাও এ ভাবে কাটল। তার পর দিন অফিস যাওয়ার একটু আগে স্বর্ণাভ বলল, ‘আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে চলো, কাছেই ব্যাঙ্ক। লকার নিয়েছি। গয়নাগুলো রেখে আসব।’
‘লকারে রাখার কী দরকার। আমার কাছে তো ভালই আছে ওগুলো।’
‘দরকার আছে বলেই বলছি।’
ঝুমুর কথা না বাড়িয়ে ব্যাঙ্কে গেল। লকার দু’জনের নামেই। গয়না দু’জনেই গুছিয়ে রাখল। তবে স্বর্ণাভ জানল না, ঝুমুর গয়নার একটা লিস্ট করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। বাড়ি এসে স্বর্ণাভ লকারের চাবি নিজের ঘরের ড্রয়ারে রাখল। ঝুমুর দেখল কিন্তু কিছু বলল না।
চতুর্থ দিন রাতে ডিনার টেবিলে স্বর্ণাভ বলল, ‘আগামী শুক্রবারে অষ্টমঙ্গলা। আগে কাঁচরাপাড়া একটু ঘুরে তার পর কলকাতায় তোমার বাড়ি যাব। ওখানে বোধ হয় আমাদের একসঙ্গে দু’রাত্রি থাকতে হবে। জোড় খোলার এই নাকি নিয়ম।’
‘দুই বাড়িতেই বলে দিয়ো আমি অষ্টমঙ্গলা করতে যাব না।’ স্বর্ণাভ শুনল কিন্তু কোনও মন্তব্য করল না। ঝুমুর মনে মনে বলল, আবার একটা নাটক? কিছুতেই না। জোড় খুলতে হলে এখান থেকে খুলেই পালাব। একা একা দিন কেটে যাচ্ছে ঝুমুরের।
মাঝে মাঝে ফুল নিয়ে আসে স্বর্ণাভ। রজনীগন্ধার একগুচ্ছ স্টিক। এনে ডাইনিং টেবিলের ফুলদানিতে রেখে দেয়। ওর হাতে দেয় না। না দিল তো বয়েই গেল। ঝুমুর চেয়েছে নাকি ফুল? বীথিকে মাঝে মাঝে ফোন করে ঝুমুর, বীথিও করে। ওকে বোঝায়। জীবনকে মেনে নিতে বলে। বীথিকে ঝুমুর এখানকার কথা সবই বলে। স্বর্ণাভ যে এখন আবার রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে, সেটাও জানায়।
বীথি সব শুনে বলল, ‘পুরুষ মানুষকে অত ছাড় দিতে নেই রে ঝুমুর।’
‘কী করবে? বাইরে এক্সট্রা ম্যারিটাল লাভ? তার আগেই আমি এখান থেকে পালাব।’
‘সে কী কথা? পালাব আবার কী?’
‘কী করব? লোকটার ওপর তো আমার কোনও টানই পড়েনি।’
‘একটু চেষ্টা কর। হয়তো তোকে ভয় পায় বলেই কাছে আসে না।’
ঝুমুর ফোন ছেড়ে দিল। ওর কিছু ভাল লাগে না। এ ভাবে চললে ও অবসাদ-রোগী হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে দীপ্তিমানের কথা খুব মনে পড়ে। স্বর্ণাভ রোজই অফিস যাওয়ার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক বার বলে, ‘আমি বেরোচ্ছি।’ ঝুমুর শোনে কিন্তু কোনও উত্তর দেয় না। এগিয়েও যায় না। কাকে বলে যায় স্বর্ণাভ? দেওয়ালকে? কোনও দরকার নেই ঝুমুরের উত্তর দেওয়ার।
কয়েক দিন ধরে রজনীগন্ধার বদলে জুঁই ফুলের মালা এনেছিল স্বর্ণাভ। বাইরের ঘরে সাজিয়ে রেখেছে নিজেই। রেখেছে রেখেছে, ঝুমুরের কী? কাল আবার গ্ল্যাডিওলাই এনেছে। অত রাতে কে দেখতে যায় ফুল? ঝুমুর তো এখন আগেই ডিনার করে নেয়। স্বর্ণাভ মাসিকে বলেছে আমার ফিরতে রাত হয় তাই বউদিকে আগে খেয়ে নিতে বোলো। খেয়ে তো নেবেই ঝুমুর। নাকি পতি দেবতার কোন কুঞ্জ থেকে ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকবে? আজ স্বর্ণাভ অফিসে যাওয়ার সময় মাসিকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোন ফুল ঝুমুর ভালবাসে, তা হলে সেই ফুলই আনবে। গা জ্বলে গেল ঝুমুরের। কাণ্ডটা দেখো, এটা আবার কাজের মাসিকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে? রাগী গলায় ও চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘কেন, আমি যদি স্বর্গের পারিজাত পছন্দ করি, তা হলে তাই আনবে বুঝি?’ স্বর্ণাভ বেরিয়ে গেল।

সব পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে ঝুমুরের। বীথিকে জানাতে হবে সব কিছু। কিন্তু হঠাৎই ওর সেলফোনটা জল লেগে নষ্ট হয়ে গেল। এ বার কী করবে ও? শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি করে একটা চিঠি লিখল বীথিকে, তার পর মাসিকে ডেকে কড়া গলায় হুকুম দিল, ‘এখনই গিয়ে চিঠিটা পোস্ট করে এসো।’ মাসি কী বুঝল কে জানে! চিঠিটা নিল।
ঝুমুর ভাবতে লাগল, এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় গয়নাগুলো নিয়ে যাবে ও। কিন্তু সেটা করতে হবে গোপনে। স্বর্ণাভ অফিস চলে গেলে কাজটা সারতে হবে।
পর দিনই সুযোগ এসে গেল। মাসি ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেল। ঝুমুর গিয়ে ঢুকল স্বর্ণাভর ঘরে। কিন্তু চাবিটা তো সেখানে নেই! দপ করে মাথায় রাগ উঠে গেল ঝুমুরের। লোকটার মাথায় কী শয়তানি বুদ্ধি! ভাল কথায় ঝুমুরকে ভুলিয়ে গয়নাগুলো হাতালো। অনেক খুঁজে ঝুমুর চাবিটা বার করল। স্বর্ণাভর আলমারির ড্রয়ারে ছিল ওটা। ব্যাঙ্ক কাছেই। অপারেশন শেষ করে চাবিটা আবার যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল। গয়নার পুঁটলিটা সুটকেসের একেবারে নীচে রাখল। কয়েকটা ভাল শাড়ি আর কসমেটিক্স গুছিয়ে নিল। কাল সন্ধের ট্রেন। সোনারপুরকে টা-টা জানিয়ে চিরতরে বিদায় নেবে ঝুমুর।
আজ একটা অন্য রকম সকাল হল ঝুমুরের। মনের মধ্যে বাঁশি বাজছে ওর। মুক্তির বাঁশি। খাওয়া হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। গোছগাছ শেষ। বিকেল হয়ে গিয়েছে। সাজপোশাক পরে ফেলল ঝুমুর। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ সন্ধের আগেই স্বর্ণাভ এসে হাজির। কী আর হবে? সামনে দিয়েই যেতে হবে। ভালই হল। লুকিয়ে যেতে হল না। হাতব্যাগটা শেষ বারের মতো দেখে নিতে গিয়ে দেখল মানিব্যাগটা নেই। ওর স্পষ্ট মনে আছে, এখানেই ছিল। শ’পাঁচেক টাকাও ছিল ব্যাগে। নিশ্চয়ই মাসির কাজ। চেঁচিয়ে উঠল ঝুমুর, ‘চোর পুষে রেখেছে বাড়িতে। তখনই বুঝেছিলাম, বউদি-বউদি করে কেন এত আদিখ্যেতা।’ চেঁচিয়ে রাগ হয়তো কমল, কিন্তু টাকা না থাকলে ট্রেনের টিকিট কী করে কাটবে? ঠিক আছে ঘড়িটা দিয়ে টিকিট কেটে নেবে। আর দেরি করা যাবে না, বীথিকে সময় দেওয়া আছে।
ঝুমুর গটগট করে হেঁটে স্বর্ণাভর সামনে এসে গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’
‘সত্যিই তুমি চলে যাবে?’
‘হ্যাঁ, কেন আটকাবে নাকি?’
‘আটকাতে পারি, কারণ তুমি আমার দায়িত্বে আছ।’
‘পারবে না’। ঘাড় শক্ত করে জবাব দিল ঝুমুর। তার পর তাড়াহুড়ো করে দরজা দিয়ে বেরনোর সময় চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার জুতো? সেটাও হাপিস! বেশ, লাগবে না জুতো, আমি হাওয়াই চপ্পল পরেই যাচ্ছি।’
ঝুমুরের পেছন পেছন স্বর্ণাভ বেরিয়ে এল, ‘ঝুমুর শোনো, তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’ তরতর করে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে ঝুমুর। এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।
সামনেই একটা সাইকেল রিকশা। উঠে পড়ল সেটায়, ‘স্টেশন চলো।’ সাইকেল রিকশা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর এক বার পেছন ফিরল ঝুমুর। আরে কী সর্বনাশ! সাইকেল চালিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কে আসছে ওটা? স্বর্ণাভ না? ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসছে, নাকি আটকাতে?
‘এই রিকশাওয়ালা, জোরে চালাও। আরও জোরে। সোজা স্টেশন গিয়ে থামবে।’ আর এক বার পেছন ফিরল ঝুমুর, আসছে সে। হুহু করে চলে আসছে।
রিকশাওয়ালাকে আবার তাড়া দিল ঝুমুর, ‘আর একটু জোরে চালাও।’ একটু পরেই স্টেশনে পৌঁছে গেল ও। তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে সাইড ব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বার করে রিকশা ভাড়া দিয়েই এগোল ঝুমুর। কিন্তু ততক্ষণে এসে গেছে স্বর্ণাভ। সামনে পথ আটকে দাঁড়াল।
‘আমি ফিরে যাব না।’
‘ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসিনি। তোমার কয়েকটা জিনিস রয়ে গেছিল, সেগুলো দিতে এসেছি। আর একটা কথা, গায়ের রং তো আর ফর্সা করা যাবে না, কিন্তু গালের এই দাগগুলো যাতে সারানো যায় সে জন্য এক জন ডার্মাটলজিস্টের চেম্বারে যাচ্ছিলাম। সে জন্যই ফিরতে রাত হচ্ছিল। ভেবেছিলাম চেহারাটা একটু সারিয়ে তোমার সঙ্গে... যা-ই হোক সে আর হল না। এইগুলো রাখো।’
স্বর্ণাভ পকেট থেকে বার করল ঝুমুরের মানিব্যাগ। আর শার্টের ভেতর থেকে একজোড়া সোনালি জুতো বের করে এনে লজ্জিত হেসে বলল, ‘যাতে চলে যেতে না পারো তাই এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম। মাসি কিছু চুরি করেনি।’ তার পর প্যান্টের পকেট থেকে স্বর্ণাভ বার করল একটা কাগজ, বলল, ‘অনার্স না থাকলেও ডিসট্যান্স-এ এম এ পড়া যায়। তোমার জন্য একটা ফর্ম এনেছিলাম। এটাও রেখে দাও।’
যেন সামনে কেউ সাজিয়ে রাখছে রজনীগন্ধা, জুঁই কিংবা গ্ল্যাডিওলাই।
ঝুমুর কোনও কথা বলতে পারছে না। স্বর্ণাভই বলল, ‘তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বীথি আবার তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। ও হ্যাঁ, আর একটা জিনিস।’ বাঁ দিকের বুক পকেটে হাত দিল স্বর্ণাভ, এ বার কি ও পারিজাত বার করবে নাকি? ভাবল ঝুমুর। না, স্বর্ণাভ একটা চাবি বার করে ম্লান হেসে বলল, ‘তোমার গয়নাগুলো মিছিমিছি লকারে পড়ে রইল। এই যে লকারের চাবিটা।’
কলকাতার ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঝুমুর বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে সামনে। বাবা যেন কী সব বলেছিল এই লোকটার সম্বন্ধে...।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.