|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
সে উল্লাস ব্যক্ত করেছেন গানে গানে |
রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘...তিনি প্রথম আলাপেই আমার মতো অর্বাচীনের সঙ্গে দু’ঘণ্টা ধরিয়া কথা বলিয়াছিলেন’। ১৯০৪-এ বি এ পাশের পর থেকে দশ বছর শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেন অজিতকুমার। তারপর কোনও কারণে তিনি আশ্রম ত্যাগ করলেও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল অটুট। ১৯১৮-তেও শান্তিনিকেতনে ওঁর ‘স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্যে একটা কোনও উপায় বোধ হয় শীঘ্র করা যেতে পারে’ এমন আশ্বাস স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। এমনকি সে বছর ৭ পৌষ উপলক্ষে সভাপতিত্ব করার জন্যও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে প্রয়াত হন অজিতকুমার। সে দিন তখনও মৃত্যুসংবাদ অজানা এক চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: ‘...ও যদি চলে যায় ত একটা ফাঁক রেখে যাবে।’ জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী লিখিত, কিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ সমৃদ্ধ, এক সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যঋদ্ধ জীবনীগ্রন্থ অজিতকুমার চক্রবর্তী (৫০.০০) প্রকাশ করে শ্রদ্ধা জানাল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
বিভাসকান্তি মণ্ডলের রবীন্দ্রনাথ: একটি উত্তর আধুনিক পাঠ (দে’জ, ৬০.০০) লেখকের রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। ভারতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি কী ভাবে মানবচেতনার স্তরে স্তরে এক মহাবৃক্ষের মতো বিরাজমান, সে আলোচনাই করেছেন লেখক।
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ‘গল্পসল্প’-র এক জায়গায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘মনে হত পাকা ধানে বাঁশি যেন বাজানো,
মায়ের আঁচল ভরা দান যেন সাজানো।’
অপরূপ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অঙ্গাঙ্গী মিলনকথা ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ঋতুনাট্যগুলিতে। ‘রবীন্দ্রনাথের এই নাটকগুলির অনুপ্রেরণা প্রাচীন ভারতের ঋতু উৎসবের আয়োজন’ বলেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য, তাঁর ঋতুনাট্যের রবীন্দ্রনাথ (এবং মুশায়েরা, ২০০.০০) বইতে। ১৯০৮-এর শারদোৎসব থেকে ১৩৪১ বঙ্গাব্দের ‘শ্রাবণগাথা’ পর্যন্ত সব ক’টি ঋতুনাট্যের আলোচনা করে লেখক ‘ঋতুর আবর্তন’ অংশে অন্যান্য নাটকেও কী ভাবে ঋতুর সামগ্রিক রূপ প্রকাশিত, তা তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ন’টি নাটক চিত্রাঙ্গদা, প্রকৃতির প্রতিশোধ, রাজা ও রাণী, বিসর্জন, মালিনী, শারদোৎসব, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, মুক্তধারা ও রক্তকরবী-র ইংরেজি অনূদিত রূপ আর মূল পাশাপাশি সাজিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর রবীন্দ্র অনুবাদে রবীন্দ্রনাটক/ রূপান্তরিত সৃষ্টি (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২৫০.০০)। পরিচিত নাটকগুলির ইংরেজি রূপ তেমন চেনা নয়। গবেষণা সন্দর্ভ হলেও এর অনায়াস পাঠযোগ্যতা থাকায় সকলেই উপকৃত হবেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ (১৮৯৩)-এর মতো ‘সাহিত্যসভা’ (১৯০০)-ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়িতে। এর ইতিহাস অনালোচিত। ‘সাহিত্যসভা’ থেকে ‘সাহিত্য সংহিতা’ নামে যে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত, সে কথাও অনেকেরই অজানা। শিক্ষক অমরনাথ করণের সাহিত্য সংহিতা পত্রিকায় রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ১৩০.০০) বইটিতে সেই সব অজানা ইতিহাস ব্যক্ত হয়েছে। ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’-র ‘কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বী’ ‘সাহিত্য সংহিতা’-য় রবীন্দ্র সমালোচনার ধারা কেমন ছিল, তাও এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। তবে, বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রবীন্দ্রনাথের ‘কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে’, ‘তোমারি নামে নয়ন মেলিনু পুণ্য প্রভাতে আজি’ ও ‘তোমার বীণায় কত তার আছে’ গান তিনটির স্বরলিপি সংগ্রহ। এর মধ্যে প্রথম দু’টির প্রচলিত স্বরলিপি আর ‘সাহিত্য সংহিতা’-র স্বরলিপি ভিন্ন। তৃতীয়টি গান হিসেবে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। তিনটিরই স্বরলিপিকার প্রফুল্লকৃষ্ণ দেব।
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য রচিত রবীন্দ্রনাথ ও মোপাসাঁ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (এবং মুশায়েরা, ১২৫.০০) বইটি লেখিকার রবীন্দ্রনাথ ও মোপাসাঁ, রবীন্দ্রনাথ ও অতি-প্রাকৃত, ঠাকুরমার ও ঠাকুরদাদার ঝুলি: একটি পাঠ এবং চণ্ডীমঙ্গলে খাদ্য আচার প্রবন্ধ চারটির বাংলা অনুবাদের সংকলন। প্রথম তিনটির অনুবাদক তাঁর স্বামী প্রয়াত লোকনাথ ভট্টাচার্য। শেষ প্রবন্ধটির অনুবাদ তাপস রায়ের। ‘নারীর মুক্তিকামী মোপাসাঁ ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন’ লিখেছেন ফ্রাঁস। প্রতিটি প্রবন্ধই সুচিন্তিত, অনুবাদও প্রাঞ্জল।
“সংহিতা বলছেন, দেবতা ‘উশন্’, ‘অস্ময়ু’, উতলা, অধীর, কাঙাল আমার জন্যে, আমাদের জন্যে। দেবতার এই ব্যাকুল কামনার স্পর্শ রবীন্দ্রনাথ বারবার পেয়েছেন। আর বারবার সে শিহরণ, সে উল্লাস ব্যক্ত করেছেন গানে গানে
“অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে
নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে॥’’
এমন ভাবে বেদ আর রবীন্দ্রসাহিত্যকে সমান্তরালে সাজিয়ে এক সুগভীর আলোচনা করেছেন গৌরী ধর্মপাল তাঁর বেদ ও রবীন্দ্রনাথ (সোমলতা/ বাঙলার মুখ, ১০০.০০) বইটিতে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আস্বাদন।
হেমলতা ঠাকুরের স্মৃতিচারণে জানা যায়, ‘প্রতিদিন প্রাতরাশের পর গুরুদেব বুদ্ধমন্দিরে গমন করতেন একাকী এবং প্রায় তিন ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করতেন।’ বুদ্ধগয়ায় গিয়ে কবি এ ভাবে শ্রদ্ধা জানান তথাগতকে। ১৩৪২ বঙ্গাব্দে কলকাতায় বুদ্ধের জন্মোৎসবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি, আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।’ বুদ্ধ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনুধাবন নিয়ে প্রবোধচন্দ্র সেন, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, কাজুও আজুমা প্রমুখের ১৬টি প্রবন্ধের সংকলন রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধচর্চা (সম্পা: হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরি, একুশ শতক, ২০০.০০)।
রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তা (জয়দুর্গা লাইব্রেরি, ১২০.০০) বইটি সুবোধ চৌধুরির রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রবন্ধ-সংকলন। প্রবীণ শিক্ষক ‘নিঃসঙ্গ অসুস্থ’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছিলেন বলে জানিয়েছেন। ‘লেখকের কথা’ অংশে আছে, ‘...তাঁর (অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের) সমাজচিন্তা ও গ্রামকে ভালোবাসা এবং গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে এর আগে এত বিস্তৃতভাবে বই কেউ লেখেননি’, তাই কি? |
|
|
|
|
|