|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ভিতরেরই কোনও কারণ কি দায়ী |
মিলন দত্ত |
হান্টার থেকে সাচার, মইনুল হাসান। বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, ২০০.০০
বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুর, আফরোজা খাতুন। দে’জ, ১৫০.০০ |
উইলিয়াম উইলসন হান্টারের বই দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস (১৮৭১), গোপাল সিংহ কমিটির রিপোর্ট (১৯৮২), রাজিন্দর সাচার কমিটির রিপোর্ট (২০০৬) এ দেশের মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে এই তিনটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন। হান্টারের প্রতিবেদন এবং সাচারের রিপোর্ট কেবল মুসলমানদের হাল জানার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। গোপাল সিংহ কমিটি গঠন করা হয় দেশের সমস্ত সংখ্যালঘুর জন্য। কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্টের পরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি স্তরে এবং একই সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে যে তোলপাড় শুরু হয় তা এর আগে কখনও হয়নি।
তিনটি রিপোর্টেই মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থার শোচনীয় চিত্র এবং শিক্ষা আর সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের বেহাল দশা প্রকাশ্যে চলে আসে। কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়েই কেন রাজনৈতিক দল এবং সরকার হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল তার কোনও ব্যাখ্যা মইনুল হাসান দেননি। এ রাজ্যে মোট জনসংখ্যার সিকি ভাগেরও বেশি মুসলমান। রাজ্যে মুসলমান জনবিন্যাসের ধরনটা এখন এমনই যে প্রায় ১২৫টা বিধানসভা আসনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে ওই সংখ্যালঘু ভোটের ওপর। তা ছাড়া মুসলমানরা এখন নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে যথেষ্ট না হলেও, আগের চেয়ে বেশি সোচ্চার। এই সব নানা কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হঠাৎই মুসলমানের বিশেষ ‘গুরুত্ব’ তৈরি হয়েছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পরে মুসলমানের উন্নয়নে বিস্তর প্রকল্প ঘোষণা হয়েছে, সংরক্ষণের নানাবিধ উদ্যোগ শুরু হয়েছে, প্রচুর ইফতার পার্টি হয়েছে, মৌখিক ‘তোষণ’-এর মাত্রা বেড়েছে। তাতে মুসলমানের গায়ে ‘তোষণ’ নেওয়ার দুর্নাম আরও এঁটে বসেছে। কিন্তু গ্রামের অক্ষরহীন, হতদরিদ্র মুসলমানের বিশেষ লাভ হয়নি।
সিপাহি বিদ্রোহের পরে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়তে থাকে। তখন ‘মুসলমানরা কি তাদের ধর্মের নিগড়ে বাঁধা, নাকি তারা রানির বিরুদ্ধাচারণ করতে চায়?’ এমন এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়ো হান্টারকে একটি প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেন। ওই সময়েও অবিভক্ত বাংলায় সরকারি চাকরিতে মুসলমানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ১৮৭১ সালের এপ্রিল মাসে বাংলায় সরকারি চাকরির যে বাঁটোয়ারা দেখানো হয়েছে, সেখানে মোট চাকুরের সংখ্যা ২১১১ জন। তার মধ্যে ইংরেজ ১৩৩৮, হিন্দু ৬৮১ এবং মুসলমান মাত্র ৯২ জন। হান্টার জানাচ্ছেন, ‘১৮৬৯ সালে আমি যখন ভারতীয় আইন ব্যবসার পরিসংখ্যান গ্রহণ করি, তখন এই রকম অবস্থা ছিল মহারানির ছয় জন আইন কর্মচারির মধ্যে চারজনই ইংরেজ ও দুই জন হিন্দু ছিলেন, কিন্তু একজনও মুসলমান ছিলেন না। হাইকোর্টের কুড়ি জন উল্লেখযোগ্য কর্মচারীর মধ্যে সাতজন হিন্দু ছিলেন, একজনও মুসলমান ছিলেন না। ১৮৭১ সালে বাংলায় মোট জনসংখ্যার ৩২% ছিল মুসলমান। অথচ সরকারি চাকরিতে মুসলমান ছিল ১১%।’
দেশভাগের পরে গোপাল সিংহ কমিটি যখন রিপোর্ট তৈরি করেছে তখন দেশে মুসলমানের সংখ্যা ৬.১৪ কোটি, মোট জনসংখ্যার ১১.২%। ১৯৬১-৭১ সালের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ৩০.৮৫%। আর ২০০৬-এ সাচার কমিটি যখন রিপোর্ট পেশ করছে তখন দেশে মুসলমান জনসংখ্যা ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার ১৩.৪%। ১৯৯১-২০০১-এ দেশে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৪৯%। ওই দশকে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৪%। ভারতীয় জনসংখ্যার ২৭.৮% যখন গ্রামে বাস করে তখন ৩৫.৭% মুসলমান শহরবাসী। তবে বাংলার মুসলমানের বেশির ভাগটাই গ্রামবাসী। বিভিন্ন প্রবন্ধের পরতে পরতে এমন জরুরি বহু পরিসংখ্যান রয়েছে।
রাজ্যসভার সিপিএম সদস্য মইনুল হাসান এ বইয়ে ভারতীয় মুসলমানের দুরবস্থার দীর্ঘ পরম্পরা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মুসলমান শাসনের অবসানের পরে গত দুশো বছরের বেশি সময় জুড়ে মুসলমানের দুরবস্থার জন্য মূলত ইংরেজ শাসনের পরবর্তী কালে ভারত সরকারকে দায়ী করেছেন মইনুল হাসান। মুসলমানের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য ওই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরের কোনও কারণকে, আংশিক ভাবে হলেও দায়ী করা যায় কিনা তার কোনও হদিস এ বইয়ে মইনুল দেননি। তিনি বরং ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে ‘পৃথিবী জুড়ে আধুনিক বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিতে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ছে’, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে বলেছেন, ‘ইসলাম নিজে থেকে কিন্তু শিক্ষা এবং অনুসন্ধিৎসার পথে কোনও বাধা সৃষ্টি করে না। ভিতরের কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ইসলামকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করে তা আধুনিক শিক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।’ তারা কারা? কোরান, হাদিস আর শরিয়তকে হাতিয়ার করে মুসলমানদের যারা পিছন থেকে টেনে ধরতে চায়, ধর্মের সেই ঠিকাদারদের কথা কি বলতে চেয়েছেন মইনুল? এ বইয়ে তা স্পষ্ট নয়। স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের ভুরিভুরি উদাহরণ তুলে এনেছেন এ বইয়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে তিনি বামফ্রন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ সাচার রিপোর্ট জানাচ্ছে, বামফ্রন্ট ত্রিশ বছর শাসন করার পরেও এ রাজ্যে সরকারি চাকরিতে মুসলমান মাত্র ২.১%।
বইয়ের অন্তিম পর্বে তিনি অনেকটা জায়গা জুড়ে ‘সংখ্যালঘু’ উন্নয়নে বামফ্রন্টের গৃহীত প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত বিবরণ লিখেছেন। বহু প্রয়োজনীয় তথ্য এ বইয়ে একত্র করেছেন মইনুল। তিনি জানিয়েছেন, গোপাল সিংহ কমিটির পরে সেই আশির দশক থেকেই সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বৈষম্য নিয়ে তাঁরা সরব। তাঁর পার্টি যে ‘সংখ্যালঘু মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে বরাবর’ সেটা জানাতে ভোলেননি। এ রাজ্যের মুসলমানের পিছিয়ে পড়ার কারণ তাঁর মতে ‘দেশভাগ এবং একটার পর একটা রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এ রাজ্যের মুসলমানদের একটা বড় অংশের কাছে এই দেশকে নিজের দেশ ভাবতেই সাহায্য করেনি। প্রায় পুরো শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মুসলমান অংশটা চলে গেল ‘বিনিময়’ করে পূর্ব পাকিস্তানে। ...শিক্ষাহীন, মধ্যবিত্তহীন একটা সমাজ যেমন হতে পারে সেটাই হয়েছে।’
শিক্ষাহীন, মধ্যবিত্তহীন যে মুসলমান সমাজের কথা মইনুল বলেছেন, সেই সমাজে নারীর অবস্থার একটা ছবি পাই আফরোজা খাতুনের বইয়ে। মুসলমান সমাজে নারীর অবস্থা ও অবস্থান দুই বাংলার কথাসাহিত্যে কী ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, মূলত তার বিবরণ রয়েছে এ বইয়ে। বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা নেই বললেই চলে। সেই কারণেই ‘বাংলার সামাজিক নবজাগরণ ও বাঙালি মুসলিম সমাজ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মাত্র সাড়ে পাঁচ পাতা জায়গা পেয়েছে। আর ‘ইসলামি আইনের প্রেক্ষাপট ও বাঙালি মুসলমান নারী’-র আলোচনা সম্পূর্ণ হয়েছে চার পাতায়। এ রাজ্যে গল্প-উপন্যাসে মুসলমান সমাজের অনুপস্থিতি উদ্বেগজনক ভাবে কম। ফলে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহ বা দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে অবৈধ ‘তিন তালাক’-এর শিকার মেয়েদের চরম দুর্দশার বৃত্তান্ত এ বইয়ে পাই না। কারণ এখানকার সাহিত্যে প্রান্তিক মুসলমান সমাজ গরহাজির। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই সব প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। অথচ শরিয়তি আইনের নিগড় থেকে মুক্ত করে মুসলমান নারীকে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের আওতায় আনার আন্দোলনে আফরোজা খাতুন নিজেই তো অগ্রণী কর্মী। কেবল গবেষণাপত্র না ছেপে, মুসলমান অন্তঃপুর নিয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা এ বইয়ে শামিল হলে পাঠক সমৃদ্ধ হতেন। |
|
|
|
|
|