|
|
|
|
আশ্বাসই সার |
শিল্পশহরে সেই দুর্ভোগেই বস্তিবাসী |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
সময় গড়িয়ে যায়। হলদিয়ায় উন্নয়ন-উদ্বাস্তুদের সমস্যা এবং ও জবরদখলের জট রয়ে যায় সেই তিমিরেই। রাজ্যে পালাবদলের ভোটে হলদিয়ায় উদ্বাস্তু পরিবারগুলির পুনর্বাসন ও বস্তি-উন্নয়নের অঙ্গীকার করেছিল তৃণমূল। কিন্তু মহকারণে ক্ষমতা দখলের পাঁচ মাস পরেও তাদের তরফে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। একটামাত্র ঝুপড়ি-ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু বাসিন্দা। অভিযোগ, এই মানুষগুলির দিকে ফিরেও তাকায় না পুরসভা কিংবা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ। এক-একটি ভোটের আগে শুধু প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায় নানা রঙের ঝান্ডায় মোড়া সভামঞ্চ থেকে। উদ্বাস্তু মানুষগুলির পুনর্বাসন আর কবে হবে বা কী ভাবে এবং তাঁরা কবে ‘অস্বাস্থ্যকর’ পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবেন--শিল্পশহরে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই প্রশ্নই। |
|
শিল্পতালুকর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে এমন ঝুপড়ি-ঘর। ছবি: আরিফ ইকবাল খান |
বস্তুত, বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় থেকেই উন্নয়ন-উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে শিল্পশহরে। বন্দরের অতিরিক্ত জায়গায় তেমন কিছু মানুষ শুরু করেন বসবাস। তাঁদের সঙ্গে পরে যোগ হয়েছে নন্দীগ্রাম, কাঁথি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা গরিব মানুষও। পরে আরও নানা প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। ফলে ভিটেহারা হয়েছেন বহু মানুষ। কথা ছিল পুনর্বাসন দেওয়া হবে প্রত্যেককে। পুনর্বাসনের কিছু ব্যবস্থা করা হলেও অনেক ভিটেহারা-জমিহারাই থেকে গিয়েছেন উদ্বাস্তু হয়েই। তাঁরা মাথা গোঁজার প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়েছেন শিল্পতালুকের রানিচক, চিরঞ্জীবপুর, রায়রাঞাচক এলাকায়। এখন সেগুলিই কার্যত ‘বস্তি’ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
রানিচক, চিরঞ্জীবপুরের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বস্তিবাসীর দাবি, ১৯৭৩ সাল থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের জায়গাতেই ছিলেন তাঁরা। স্থায়ী ভাবেই বসবাস করছিলেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে ফের জমিহারা হতে হয়েছে। তার পর আস্তানা তৈরি হয়েছে সিপিটি ও রেলের জায়গার মাঝে রেললাইনের ধারে। প্রথমে সাময়িক অসুবিধা থাকলেও পরে নিজেদের ইচ্ছেমতো কার্যত জবরদখল করেই ‘বস্তি’ গড়ে তুলেছেন তাঁরা। সায় দিয়েছেন সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই। চিরঞ্জীবপুরের এখনও ঝুপড়িতে থেকেই কর দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। ভোটার তালিকায় নাম থাকায় ভোটও দিচ্ছেন তাঁরা। তবে পুর-এলাকার ন্যূনতম পানীয় জলের পরিষেবাও পান না তাঁরা। নেই পথবাতি।
লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে হলদিয়ায় ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। বস্তি উন্নয়ন, উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা ভোটের আগে। অন্য দিকে, পুরসভায় ক্ষমতায় রয়েছে বামেরা। তারাও বছরের পর বছর একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছে। এখন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদও তৃণমূল-নিয়ন্ত্রিত। আগে সেটা ছিল বামেদের নিয়ন্ত্রণে। সামনেই ফের একটা পুর-নির্বাচন। ফের বস্তিবাসীদের নিয়ে রাজনীতি চলবে। কিন্তু তাঁদের দিনযাপনের হাল ফিরবে কি?
চিরঞ্জীবপুরের তারকনাথ অধিকারী, শেখ জামাল, শেখ রাজুদের কথায়, “আমাদের ভোটার কার্ড আছে। ঘরের জন্য কর দিই। লক্ষ্মণবাবুদের (শেঠ) এক সময়ে আমরা জিতিয়েছি। এখন তৃণমূল করি। ভোটের আগে সব নেতাই আসেন ভোট চাইতে। অসুবিধার কথা জানালে শুধু বলেন, হবে হবে। আজ পর্যন্ত কিছুই হল না। বর্ষায় খালের জল ঘরে উঠে আসে। এ ভাবে কি বাঁচা যায়?”
আরও করুণ অবস্থা পরমানন্দচক, ধান্যঘাটা, পাতিখালি এলাকার বাসিন্দাদের। পরমান্দচক ও ধান্যঘাটা এলাকায় প্রায় তিন হাজার মানুষের ভরসা একটিমাত্র টিউবওয়েল। এলাকায় বিদ্যুদয়ন হয়নি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, “আমরা ভোট দেওয়ার দিয়ে যাই। কেউ এত দিনেও কিছু করেনি। জানিনা আগামী পুরভোটের পর কী হবে! প্রাথমিক ভাবে জলের প্রয়োজন। এ ছাড়াও পুনর্বাসনের দাবিও জানিয়ে আসছি অনেক দিন ধরেই। কিন্তু কেউ মুখ তুলে দেখেনি।” কুমারচক, হাতিবেড়িয়া, দুর্গাচক, ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের লিঙ্ক রোড ও সিটিসেন্টার থেকে পুরসভা যাওয়ার রাস্তাতেও রয়েছে সারি সারি ঝুপড়ি-ঘর। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সব জেনেও নির্বিকার পুরসভা থেকে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ। শুধু ‘হচ্ছে হবে’ এই আশ্বাসে চাঁচের ঘরে নিশিযাপন করছেন কয়েক হাজার মানুষ।
হলদিয়ার উপ-পুরপ্রধান নারায়ণচন্দ্র প্রামাণিকের যুক্তি, “আমি জানি ওই এলাকাগুলিতে সমস্যা রয়েছে। তবে আমাদের নিজেদের তো কোনও জায়গা নেই যে পুনর্বাসন দেব। তবে জলের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চলছে। আরও টিউবওয়েলের বন্দোবস্ত করা যায় কি না, দেখছি।” হলদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমন হাওলাদারের আবার বক্তব্য, “এক সময়ে অনেকের পুনর্বাসন হয়েছে। তবে কিছু মানুষ বাদ থেকে গিয়েছেন হয়তো। আবার অনেকে অন্য জায়গা থেকে এসেও জবরদখল করে থাকছেন। সে কারণেই সমস্যা বেশি।” হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের সিইও পি উলাগানাথনের বক্তব্য, “আমাদের দ্বারা অধিগৃহীত জমির মালিকেরা অধিকাংশই পুনর্বাসন পেয়েছেন। তবে আমি জানি বিভিন্ন এলাকায় বস্তি রয়েছে। বস্তিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে আমরা ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি।”
সংশোধন। শুক্রবার প্রকাশিত ‘খোলা চত্বরেই চলছে হলদিয়ার বাস-ডিপো’ শীর্ষক প্রতিবেদনের গোড়ায় এসবিএসটিসি-র অস্থায়ী ডিপোটি হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ (এইচডিএ) ভবন-চত্বরেই মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের খোলা প্রাঙ্গণে রয়েছে ছাপা হয়েছে। ‘এইচডিএ ভবন’ নয়, হবে ‘এইচডিএ-এর জায়গা’। |
|
|
|
|
|