প্রতি পক্ষ
অল্প লইয়া থাকি...
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ফ্রেনোলজি’ নামে এক বিচিত্র বিদ্যায় খুবই উৎসাহী ছিলেন। মানুষের খুলির গড়ন দেখে নাকি তার স্বভাব, চরিত্র ইত্যাদি ইত্যাদির হদিস পাওয়া যায়, এমনই ছিল সেই অধুনা-বিলুপ্ত বিদ্যার মূল সূত্র। ঠিক ততটা দূর-সঞ্চার নয়, কিন্তু মানুষের আঁকা ছবি দেখে যদি তার মনের গড়নের একটি হদিস খুঁজতে চান কেউ, তা হলে অন্তত সেই অনুমান সর্বদা নিষ্ফলা হবে না।
অন্তত, রামেশ্বর ব্রুটার ক্ষেত্রে যে হবে না, তা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়। তিনি ছবি আঁকেন কম। বছরে মাত্র তিন-চারটে (তিনি জানালেন, বড় মাপের কাজ হলে আরও কম)। তাঁর আঁকা ছবিতে মানুষের বিচিত্র নিঃসঙ্গতা ধরা পড়ে। দূর থেকে এই সব দেখে যদি মনে হয়, মানুষটিও স্বল্পভাষী হবেন, অনুমান একশো ভাগ নির্ভুল।
বা, যদি এ রকম মনে হয় যে, ভদ্রলোক হালফিল ইঁদুর দৌড়ে নাম লেখাননি, নিজস্ব চাল এবং চরিত্রটি নিয়ে পুরনো মেজাজে দিব্যি আছেন, দুঃখিত, অনুমান একশো শতাংশ ভ্রান্ত!
কারণ, রামেশ্বর ব্রুটার মতো কম্পিউটার-মিত্র ব্যক্তি শিল্পীমহলে বিরল!
কারণ, তিনি আশ্চর্য প্রত্যয়ে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, কম্পিউটারকে আমি স্কেচবুকের মতো ব্যবহার করি। ছবির খসড়া বানাই কম্পিউটারে। তারপর সেখান থেকে সেই ছবির আদলকে রক্তে-মাংসে আরও বাড়িয়ে নিয়ে আসি আমার ক্যানভাসে।’’
না, আরও কিছু কিছু শিল্পীর মতো ক্যানভাসে সরাসরি সেই ছবিটি ছাপিয়ে নেন না তিনি। ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে তিনি অ-যান্ত্রিক! অন্তত, ওই অর্থে! তখন রং, তুলি, চারকোল, বা রং আঁচড় দেওয়ার বস্তুটি নিয়ে তিনি ছবির সামনে একলা।
অর্থাৎ, তাঁর একটি হাতে ঐতিহ্য। অন্য হাতে আধুনিকতা।
ছবি: পিন্টু মণ্ডল
‘‘ভাবতে পারেন, বছর ন’-দশেক আগে, আমি এমন একটা কম্পিউটারের পিছনে বেশ কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছি, যে সব স্পেসিফিকেশন-এর কম্পিউটারকে আজকাল খেলনা মনে হবে, কেউ ছুঁয়েও দেখবে না’’, হাসছেন রামেশ্বর, ‘‘অবশ্য তা নিয়ে কোনও খেদ নেই। কারণ, তখন ওর থেকে ভাল আর কিছু পাইনি। পরে সেটা দিয়েও দিলাম একজনকে।”
আপাতত একটি অ্যাপল ‘ম্যাক’ কম্পিউটার তাঁর সঙ্গী। এবং আধুনিকতম ক্যামেরা।
‘‘এই যে ধরুন আপনি এখানে বসে আছেন, আমার সামনে, দেখতে দেখতে আমার মনে হল, কোথাও এই দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা থেকে পরে একটা ভাল ছবি হতে পারে, তখনই আমি ছবিটা তুলে নেব। নিয়ে যাব আমার কম্পিউটারে। তারপর, তাকে ঘিরে চলবে ভাবনাচিন্তা। এই দৃশ্যের মধ্যে ছবিটা কোথায়? সেই ছবির মধ্যে আমি কোথায়?’’
সুতরাং, স্রেফ কম্পিউটার-বিহারী বলেই যদি ভাবতে চাওয়া হয় তাঁর ছবিকে, বড় মাপের একটি ভুল হবে নিশ্চিত। রামেশ্বর ব্রুটা গৃহীত দৃশ্যের ভিতরে নিক্ষেপ করেন নিজেকে। কম্পিউটার তো একটি উপকরণ, খুব তাৎপর্যপূর্ণ উপকরণ সন্দেহ নেই, কিন্তু আসলে তো উপকরণই। সেটাই তো আর সটান ছবি নয়। সেটা কোনও একটি ছবির হয়ে-ওঠার পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।
সেই ধাপটির জন্য রামেশ্বর ব্রুটা আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার কাছে কৃতজ্ঞ (‘‘প্রযুক্তি যদি আমাকে ছবির আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে, অনেক অভাবিত বাঁক নিয়ে আসে দৃশ্যের শরীরে, তা হলে কেন তাকে স্বাগত জানাব না?’’ বলছেন তিনি )।
খেয়াল রাখা ভাল, সেই ধাপটির কাছেই কিন্তু তিনি নতজানু নন।
ক্যানভাসে ছবি আঁকা তো দূরস্থান, এমনকী ছবি তোলার সময়েও তিনি একটি ‘ইমেজ’-এর সঙ্গে অন্য ‘ইমেজ’ পাশাপাশি রেখে খেলা করেন। বা, একটি ছবির হৃদয় খুঁড়ে নিয়ে আসেন অন্য কোনও আদল, আভাস, ইশারা...
‘‘প্রযুক্তি আসলে কল্পনাকে সাহায্য করেছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ’’, বলছেন রামেশ্বর, ‘‘কিন্তু যে ক্যানভাস আমার হবে, তাকে অন্যের হাতে ছাড়ব কী করে? আমার রংয়ের টানটোন, রং চাপানোর কায়দা, বা ধরুন চাপিয়ে-রাখা রংয়ের পরত আঁচড়ে আঁচড়ে অন্য একটা বুনোট গড়ে তোলা...এ সব কি কখনও সরাসরি প্রযুক্তি এনে দিতে পারবে?’’
এ ভাবেই আছেন তিনি। যুগপৎ স্মৃতি এবং সত্তায় পা দিয়ে।
একদা বেশ কয়েকটি বাস বদলে কর্মক্ষেত্রে যেতেন। প্রথম কাজটি একশো টাকাতেও বিকোয়নি। এখন বিদেশি নিলামঘরের হাতুড়ি কোটি কোটি টাকা হাঁকে।
তিনি বদলাননি মোটেই। স্বল্পভাষী। স্বল্পপ্রসূ। কিন্তু, গভীর-সঞ্চারী।
রামেশ্বর ব্রুটা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.