ব্যাগ গুছিয়ে...

বিলেতের ডাকে
হিথরো বিমানবন্দরের ঘড়িতে রাত আটটা। আধ ঘণ্টা আগে ই কে ৫৭২ বোয়িং বিমান যখন আধ-জাগা লন্ডনের মাটি ছুঁল, প্রাক্-দুর্গাপুজোর কলকাতা তখন রাত জেগে উৎসব শুরুর সব আমেজ চেটেপুটে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে।
মুজতবা আলি সাহেব তো লিখেই গিয়েছেন, ‘যার পায়ে চক্কর আছে, সে-ই বেরোয় দেশভ্রমণে। কেউ বেরোয় পণ্ডিতমশাইয়ের মতো গজরাতে গজরাতে, কেউ আবার চেন-ছেঁড়া পাখির মতো তিড়িং-বিড়িং করতে করতে, তিন লম্ফে গেট পেরিয়ে।’ আর বাঙালির পায়ের তলায় তো সর্ষে। তাই এত কাল বিদেশে মানসভ্রমণ করে এ বার ভাবছিলাম সত্যিই তার হাতছানিতে সাড়া দেব কি না। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-ব্যাঙ্ককের পাশাপাশি ইউরোপও এখন বাঙালির ‘হট লিস্টে’। সৌজন্যে শহরের বেশ কিছু ভ্রমণসংস্থার প্যাকেজ ট্যুর। আর মাত্র ১০-১১ দিনে যদি ঘুরে নেওয়া যায় ছ’টা দেশ, তা হলে তো কথাই নেই।
শুরু লন্ডন থেকে। কলকাতা থেকে যাওয়ার পথে ঘণ্টা দু’য়েকের ‘ট্রানজিট’ দুবাইয়ে। দুবাই বিমানবন্দরে দেড়খানা কলকাতা বিমানবন্দর অনায়াসে ঢুকে যাবে। কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে সোজা হিথরো। হোটেলে সাহেবি খানার পাশাপাশি মিলতে পারে হাতে-গরম বাঙালি খানাও। সে রাতে ভাল করে ঘুমিয়ে জেটল্যাগ মোটামুটি কাটিয়ে নেওয়া। পরের দিন লন্ডন শহরের গর্ব দোতলা বাসে বা ভূগর্ভ রেলে চেপে শুরু হতে পারে নগরদর্শন। ভূগর্ভ রেলে এক বার টিকিট কাটলে সারা দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। যত বার খুশি চড়ুন। স্টেশনগুলিতে তরতর করে লোকজন উঠছে-নামছে।
আরও একটা জিনিস দেখলাম। সদাব্যস্ত শহরটার পরতে পরতে একটা অলিখিত শৃঙ্খলা। ঠেলাওয়ালা-সাইকেল ভ্যানের গুঁতোগুঁতি নেই, হর্নের কানফাটানো আওয়াজ নেই, নেই অকারণ যানজট। রোদ-ঝলমল সকালে প্রথম গন্তব্য বাকিংহাম প্যালেস। রানি এলিজাবেথের এই বসতবাড়ি তার চিরন্তন আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ঢুকতে চাইলে ব্যবস্থা আছে তারও। প্রবেশপথে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ রাজরক্ষী। তার রয়্যাল ড্রেস দেখারই বটে। যদি শিল্পরসিকও হন, তা হলে ঘুরে নিতে পারেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম বা ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামও। সেখানে দুর্লভ সব পেন্টিংয়ের পাশাপাশি দেখা মিলবে কালীঘাটের পটচিত্রেরও।
এর পরে ঘোরা যেতে পারে পার্লামেন্ট হাউস, বিগ বেন বা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে। দুপুরে নির্দিষ্ট কোথাও যাওয়ার ছিল না। তাই ঠিক করলাম, শহুরে জীবনটা একটু উপভোগ করব। পাতাল রেলে সোজা অক্সফোর্ড স্ট্রিট। লন্ডনের বুকে ঠিক যেন একটুকরো চৌরঙ্গি। ফুটপাথে খবরের কাগজের স্ট্যান্ডে কিছু না হলেও গোটা কুড়ি কাগজ ঝোলানো। যাতায়াতের পথে ইচ্ছেমতো নিয়ে পড়তে পারেন। প্রাণ খুলে সেরে নেওয়া যেতে পারে শপিংও। তাতে আগ্রহ না থাকলে রাস্তার দু’ধারের ঝাঁ-চকচকে দোকান দেখে উইন্ডো-শপিংই না হয় হল।
এমন সুন্দর দিনের বিকেলে মন তো চাইবেই সবুজ ঘাসে প্রিয়জনের সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কাটাতে। হাইড পার্ক তার ঠিকানা। আর দিনের রোদ যখন একটু একটু করে মরে আসছে, কফিতে চুমুক দিতে দিতে নির্ভেজাল আড্ডা জমল টেমসের ধারে। ঢেউ গুনতে গুনতে নেমে এল মায়াবি রাত। মনে মনে তুলনা করে নেওয়া কলকাতার সঙ্গে লন্ডনের সন্ধ্যাকে। দ্বিতীয় দিনে মনে হল, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, বারাক ওবামা, আইনস্টাইন বা মাইকেল শুমাখারের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলে কেমন হয়? কী আশ্চর্য! সশরীরে নয়, মোমের মূর্তি হয়ে তাঁরা আমাদের স্বাগত জানাতে তৈরি মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে।
ভুবনজোড়া খ্যাতি এর। প্রতি দিন সারা পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার পর্যটক আসেন মাদাম তুসোর সম্মোহনী টানে। কোনও ঘরে চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কোথাও প্রশাসক, কোনও ঘরে খেলোয়াড়-বিজ্ঞানীদের ভিড়। এক ঘণ্টা ধরে ঘোরার ফাঁকে কানে এসেছিল অন্তত ১০টি দেশের ভাষা।
এর পরে ‘টাওয়ার অফ লন্ডন’-এ। বিভিন্ন কক্ষে সাজানো ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের নানা সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র। রয়েছে কোহিনূরও। টাওয়ারের সামনের প্রশস্ত চত্বরে হরেক সামগ্রী দিয়ে সাজানো দোকান। পা-কে দু’দণ্ড বিশ্রাম দিতে খোলা জায়গায় বেঞ্চে বসে টেমসের সতেজ হাওয়া খেয়ে নেওয়া। টেমসের এক ধারে আবার সুবিশাল ‘লন্ডন আই’। ঘুরন্ত নাগরদোলার মতো এই বস্তুটিতে উঠে শহরটাকে দেখা যাবে পাখির চোখে।
দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এল মাত্র দু’দিনের লন্ডন-বাস। নতুন একটা শহরকে ক্ষণিক ভালবাসার যে তৃপ্তি, তার রেশ নিয়ে এ বার চলা রোম্যান্টিক প্যারিসের পথে।

ছবি: শেখর রায়




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.