সিনেমা সমালোচনা ১...
রকস্টার কই
সুফি কবি রুমির বচন ফুটে ওঠে পর্দায় যখন ‘রকস্টার’ ফিল্মের গল্প ফুরোয়। ‘ঠিক বেঠিকের সীমানা ছাড়িয়েও অন্য একটা জগৎ আছে, সেখানে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব।’ এই সিনেমাতেও দু’টো সমান্তরাল জগতের আদানপ্রদানে। একটা শিল্প, অন্যটা সম্পর্ক। কী ভাবে শিল্পই হয়ে ওঠে সম্পর্কের নির্ধারক, অথবা উল্টোটা।
রণবীর যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাকে কখনও মনে হবে গবেট এবং গোঁয়ার, কখনও স্রেফ ‘টু দ্য পয়েন্ট’। হৃদয় না ভাঙলে সঙ্গীত হবে না এই আপ্তবাক্য শুনে সে নায়িকা হির (নারগিস ফাকরি)-এর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়তে চায়। সেই মেয়ে যে ‘হৃদয় ভাঙার মেশিন’ হিসেবে পরিচিত! এই নকল হৃদয় ভাঙা থেকে আসল হৃদয় ভাঙায় উত্তরণই হল এই সিনেমার গল্প।
কিন্তু কোনটা ঠিক, আর কোনটা ঠিক নয়? কোনটা প্রেম, কোনটা মোটেই প্রেম নয়? কোনটা হৃদয় বিদারক, কোনটাই বা তার অভিনয়? কী করে গ্রামের বোকা গুপি হবে রক আইকন, প্রতিষ্ঠানবিরোধী জিম? এমন ধারার প্রশ্নপত্র নিশ্চয়ই চলচ্চিত্রকারকে আলো দেখিয়েছে এই ছবি তৈরিতে। এবং এত কিছু সামলাতে গিয়ে তিনি খানিক ঘেঁটেও গিয়েছেন। ফলে রণবীর অভিনীত চরিত্র জর্ডন ওরফে জনার্দনকে কদাচিৎ বাস্তব, বেশির ভাগ সময়ই অকারণ ‘হটকে’ লাগে। জনার্দন সঙ্গীতে বা প্রেমে কতটা সিরিয়াস নাকি দু’টিই তার কাছে যশ লাভের উপায় মাত্র, সেটা নিশ্চিত করে বোঝা যায় না।
চরিত্রের শেড কখন কী ভাবে কোন দিকে মোড় নেবে তা স্পষ্ট ভাবে ফুটে না ওঠার অন্য কারণ চিত্রনাট্যের অসম চলাফেরা। সময়-সফর চলছে ক্রমাগত। হুড়হুড় করে বছর এগোচ্ছে। পিছোচ্ছে। ইউরোপের স্টেডিয়ামে রকের আঙিনায় প্রবেশ করছেন ‘রকস্টার’। সেই শহরেরই গলিতে আক্রান্ত হওয়ার পর। ফ্যান্টাসি তীব্র, বাস্তব শূন্য। এ ভাবে গানবাজনা হয় না। কিন্তু সিনেমাতে হয়। তানপুরা (পড়ুন গিটার) ভেঙে দেওয়ার দৃশ্য এ গল্পেও আছে, গাধায় চাপিয়ে না হলেও রয়েছে গায়ক তাড়ানোও আর ভূতের রাজার ‘বর’-এর বদলে সার্থক সঙ্গীত সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে আছে অদ্ভুত এক হবু বৌ।
রকস্টার
রণবীর, নারগিস, শম্মী কপূর
মেয়েটিকে অদ্ভুত বলছি কারণ, প্রথম অর্ধে সুস্থ, পরের অর্ধে ‘কথা নেই বার্তা নেই’, তুমুল অসুস্থ এই চরিত্র এমন হুড়ুমতাল তার কার্যকলাপে যে, সে স্ক্রিপ্টেও জ্যান্ত হয়নি। নারগিস ফাকরিও অভিনয়ের ‘গুণ’-এ যত্ন করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন।
তার পর নানা দৃশ্য-কোলাজের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে জনার্দনের প্রাথমিক ব্যর্থতার প্রেডিক্টেবল কিস্সা... এগুলো খুব একটা অবাস্তব নয়। কিন্তু পরবর্তী জীবনে যে সাফল্য, তার পটভূমিকা কি শুধুই মুখ-ফুটে না বলা, কপ করে গিলে ফেলা প্রেম? সেটা হলে তো এই গল্পের নাম ‘রকস্টার’ হওয়াটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বলে মনে হতে পারে। সেটাই হয়েছে। ঠিক বেঠিকের সংজ্ঞা হয় না... এই ঝাঁকিয়ে দেওয়া ফিলজফি অবশ্যই রকধর্মী, রুমি আর রক-কে একাকার করে দেওয়ার সুফি-রক প্রবণতাটাও মেনে নেওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে রকস্টারকে যে ডিসিপ্লিনড পরিশ্রমে আয়ত্ত করতে হয় তার শিল্প... তার বর্ণনাও ‘রকস্টার’ গল্পের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু মুশকিল হল, এই পরিশ্রম, সাধনা, শৃঙ্খলা, একাগ্রতা জনার্দনের চরিত্রের সঙ্গে মেলে না।
অর্থাৎ পরিচালক ব্যর্থতা এবং সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, কিন্তু মাঝখানের রাস্তাটা অব্যক্ত প্রেমের পলকা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েই তিনি খালাস। কাজেই জনার্দন বেচারা যথার্থ ‘রকস্টার’ হয়ে উঠতে পারেনি।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম রণবীর বলেছেন, “এটা রকস্টারের জীবনকথা নয়, এক নিপাট ভালবাসার গল্প’।” সত্যি বলতে কী রকস্টার নামের ভার এ ভাবে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর উপায়ও ছিল না। কিন্তু চরিত্রের এই ফাঁক পূরণে রণবীর যথাসাধ্য করেছেন। আবেগ এবং মুনশিয়ানা ঢেলে অভিনয় করেছেন। রণবীর এতটা প্রাণ দিয়ে অভিনয় না করলে লম্বা (দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট) এ ছবি বাঁচত না। আর এক জনের কাজকেও কুর্নিশ করতেই হবে। এ আর রহমান।
রহমান পরিচালকের থেকেও বেশি বুঝেছিলেন এ আদতে রকস্টারের গল্প নয়। তাই রক মিউজিকের তেমন একটা আশ্রয় নেননি সুরের বুনোটে। সময় যে ভাবে এ ছবির গল্পকে পৃথিবীর নানা জায়গায় নিয়ে গেছে রহমান এক জন ওয়ার্ল্ড মিউজিশিয়ান হিসেবে সেই অঞ্চল, অবস্থানকে ফলো করে গেছেন গবেষকের নিষ্ঠায়। এবং একটা চমৎকার সাউন্ডস্কেপ তৈরি করতে পেরেছেন, যার অনেক উপাদানের মধ্যে মিশে থাকা মাত্র একটি উপাদান রক হলেও তা অত্যন্ত সার্থক ভাবেই ‘রকস্টার’ ফিল্মের মৌলিক সাউন্ডট্র্যাক। প্রচলিত কোনও ধারা নয়। শব্দের এক স্বতন্ত্র চেহারা তৈরি করতে না পারলে এই ফ্যান্টাসিকে মূর্ত করা যেত না, তা বড় বাস্তব হয়ে উঠত। বাজার চলতি, বাস্তব সমাধানকে পাখির চোখ করে হাঁটেননি এ খেলায় কেউ-ই। তাই এ ফিল্মের সব চেয়ে রক-নিকট গান ‘সাডা হক’-এও কোনও দাবি নেই, আছে শুধু কিছু প্রশ্ন আর কিছু আর্তি।
সে জন্যই হয়তো শেষে ফুটে ওঠে অচেনা এক জগতের আমন্ত্রণ। জন লেননের ‘ইমাজিন’ গানে, রুমির কাব্যে, জিম মরিসনের নিস্পৃহতায় আর প্রেমিক-প্রেমিকার শঙ্কাহীন মনে সে জগৎ বাস্তব। কিন্তু জীবনে নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.