|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ২... |
|
সাবাস টিনটিন |
স্পিলবার্গের জাদু। খুদে সাংবাদিককে ছোঁয়ার সব চেয়ে সফল চেষ্টা আজ পর্যন্ত এটাই।
তবে হার্জের সরল রহস্যময়তা একটু হলেও টাল খেয়েছে। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
স্টিভেন স্পিলবার্গের জাদু-কেরামতিতে টিনটিন কমিক্সের সিনেমার সঙ্গে ইতিহাসের একটা ঘটনারই তুলনা করা যায়। জুলিয়াস সিজারের সামনে মহামূল্যবান পারস্য গালিচায় মুড়ে বিশ্বসুন্দরী ক্লিওপেট্রাকে পেশ করা। এর আগে জ্যান্ত অভিনেতা দিয়ে কী কার্টুন ফর্ম্যাটে টিনটিন-কথা যে রুপোলি পর্দায় আসেনি তা নয়, তবে তা দেখে মনে রাখা দূরে থাক, ভাল লাগারও কোনও কারণ ছিল না।
টিনটিনের নির্মাতা হার্জ তো রীতিমতো বিরক্তই ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে স্পিলবার্গের ছবি ‘ডুয়েল’ দেখে অবশেষে ওঁর মনে হয়েছিল টিনটিনকে সিনেমায় ফোটাতে কেউ যদি পারে তো এই ছোকরা। তখন স্পিলবার্গ ছোকরাই বটেন, তবে তত দিনে ছায়াছবির দুনিয়ায় হুলুস্থুল বাধিয়ে বসেছেন। তাঁর ১৯৮১-র ছবি ‘রেডার্স অফ দ্য লস্ট আর্ক’কে এক সমালোচনায় তুলনা করা হয়ে গেছে টিনটিন কমিক্সের সঙ্গে। তবে আরও তিন দশক পর টিনটিন নিয়ে তাঁর চলচ্ছবিকে কি টিনটিন কমিক্সের সঙ্গে সমান আদরে তুলনা করা যাচ্ছে? আপাতত প্রশ্ন এটাই।
এবং এর সদুত্তর একই সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। ‘হ্যাঁ’ কারণ টিনটিনকে নিয়ে রুপোলি পর্দায় থ্রিডি প্রক্ষেপণে এত রোমাঞ্চ, চাঞ্চল্য, গতি ও মজা যে ঘটানো যায় তা স্পিলবার্গ সাহেবের পাল্লায় না পড়লে কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। আবার ‘না’ এ জন্য যে এত গতি, এত রোমাঞ্চ, ছায়াছবির এত কারিকুরি ছবিকে স্পিলবার্গে মুড়ে দিয়ে হার্জের সেই ঈষৎ শ্লথ, হাসি ও বিপর্যয় তাড়িত সরল রহস্যময়তাকে বেজায় অস্থির করেছে। বইয়ে টিনটিন পড়তে পড়তে ভক্তরা যে মন্দ লয় বায়োস্কোপ দেখার আনন্দ পায়, তা হঠাৎই এক বৃহৎ লম্ফ নেয় স্পিলবার্গ কথিত ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন’-এ। তবে বাঙালির প্রায় পঞ্চাশ বছরের টিনটিন প্রেম (কারণ ওই সময় থেকে টিনটিন কলকাতার হাতে এল) এবং চল্লিশ বছরের স্পিলবার্গ ভক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে এক নতুন, অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়ায় দাঁড়িয়েছে, যা ভাল লাগা বা না-লাগার প্রশ্নকে অবান্তর করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে কেমন একটা তাজ্জব-করা, “ উরেঃ বাপ রে!” ভাব।
স্পিলবার্গের ছবি কোনও একটি টিনটিন কাহিনি নয়, ‘দ্য সিক্রেট অফ দ্য ইউনিকর্ন’, ‘দ্য ক্র্যাব উইথ দ্য গোল্ডেন ক্লজ’ এবং ‘রেড র্যাকহামস ট্রেজার’ এই তিন-তিনটে গল্পের মিশেলে তৈরি। পালতোলা জাহাজের যে যুগ, জীবন, তরোয়ালবাজি ও মজাকে অ্যাডভেঞ্চারের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন রবার্ট লুই স্টিভেনসন, সেই ধারার প্রতি এক বিনীত সেলাম হার্জের এই গল্পগুলোয়। জলদস্যু রেড র্যাকহাম জন্মজন্মান্তর ধরে খুঁজে চলেছে লুণ্ঠিত বিপুল ধনরাজি এবং বারে বারে মুখোমুখি হচ্ছে অসমসাহসী নাবিক ক্যাপ্টেন হ্যাডকের। টিনটিনের অভিন্নহৃদয়, ‘লখ লমন্ড’ স্কচাসক্ত বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক যার প্রপৌত্র। বাজারে একটা প্রাচীন জাহাজের মডেল ঝড়তিপড়তি দামে কিনে গোলমালে জড়াল বিচ্ছুু সাংবাদিক কাম ধুরন্ধর গোয়েন্দা টিনটিন। সে মডেল নাকি সারা দুনিয়ায় তিনটে, আর তাতে...না থাক, রহস্য গল্পের রহস্য রহস্যেই থাকা শ্রেয়। |
|
দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন
জেমি বেল, অ্যান্ডি সার্কিস, ড্যানিয়েল ক্রেগ |
তবে টিনটিন ঝামেলায় জড়ালে ঝামেলায় জড়ায় ওর কুকুর স্নোয়ি (‘আনন্দ’র টিনটিনের বঙ্গীয় সংস্করণে অনুবাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যার নামকরণ করেছিলেন কুট্টুস), এবং অতি অবশ্য দুই জেরক্স কপি গোয়েন্দা টমসন এবং টমসন। এক জনের নামের বানানে ‘P’ আছে (Thompson) অন্য জনের নামে ‘P’ নেই (Thomson)। তবে দু’জনের মগজেই বুদ্ধির ছিটেফোঁটার অভাব। এই টিম নিয়েই সামলাতে হচ্ছে দুর্ধর্ষ ডাকু সাখারিনকে। পাড়ি দিতে হচ্ছে সমুদ্র, মরোক্কোর বাগঘার বন্দরের পথে। শুরু হয়ে যাচ্ছে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার।
হার্জ চিরকালই অ্যাডভেঞ্চার বিস্তারের সঙ্গে একটা পর্যটনের রোমাঞ্চ যোগ করতেন। ওঁর যে-চলনটা মেলে সত্যজিৎ রায়ের ফেলু-কাহিনির সঙ্গে। বাগঘারের বাজার দৃশ্য দেখতে দেখতে হিচকক ভক্তদের মনে পড়তে বাধ্য ওঁর মরোক্কোয় তোলা ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’-এর ভিড়াক্রান্ত বাজার। সে ছবির রহস্যঘন মুহূর্তে ডরিস ডে গেয়ে উঠেছিলেন গান, ‘কে সেরা সেরা, হোয়াটএভার উইল বি উইল বি।’ আর টিনটিন ছবির মোক্ষম লগ্নে গেয়ে উঠলেন টিনটিন কমিক্সের এক অপরূপ ঝকমারি চরিত্র গায়িকা বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওরে। শেখের মেহফিলে সে গানের কেরামতি ও পরিণতি কী জানতে হলে ছবিঘরে বসুন। ও ভাষায় বর্ণনার অতীত।
বস্তুত স্পিলবার্গের টিনটিনের চোদ্দো আনাই ভাষায় বর্ণনার অতীত। স্টিভেন মফাট, এডগার রাইট ও জো কর্নিশের যৌথ চিত্রনাট্যে সংলাপের চেয়ে দৃশ্যাবলির ওপর প্রাধান্য ঢের বেশি। হার্জের অজস্র ফরাসি ঘরানার হিউমার (ভদ্রলোক যদিও বেলজীয়) চিত্রনাট্যে ইংরেজি ভোল ধরেছে। তাতে অবশ্য দোষের কিছু ছিল না যদি সেই হিউমারের পরিমাণটা আর একটু বেশি হত। তবে পকেটমারির দৃশ্যগুলো এবং টমসনদের কাণ্ডকলাপে হার্জের ছোঁয়া স্পষ্ট। যে ধ্যান ও শৈলী ছবিতে নিয়োগ করা হয়েছে থ্রিল সঞ্চারে (বাগঘার বন্দরে এরিয়াল ফটোগ্রাফি তো মনে পড়িয়ে দেয়, ‘জুরাসিক পার্ক’-এর শূন্যে নিলম্বিত ক্যামেরার কাজ) তাঁর সঙ্গে মানানসই হিউমার ছড়াতে পারলে হার্জের উপস্থিতি বাড়ত। আর ক্যাপ্টেন হ্যাডকের তুলনাহীন গালিগালাজগুলো বেশি ব্যবহারে আসতে পারত। নয় কি?
টিনটিন, হ্যাডক, টমসন ইত্যাদি চরিত্রের মেক-আপ বিলকুল বইয়ের পাতা থেকে তোলা। ফুলোনো ফাঁপানো মুখগুলির মধ্যে একটা পুতুল পুতুল ব্যাপার আছে, যেটার ভীষণ ভীষণ দরকার ছিল। যেটা একই সঙ্গে অ্যানিমেশন এবং বাস্তব রূপায়ণের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। চরিত্ররা মানুষের মতো ব্যবহার করবে, কিন্তু কার্টুনের মাত্রা থেকে বেরিয়ে আসবে না। এবং যে কাজটায় স্পিলবার্গের সিদ্ধি এক কথায় স্পিলবার্গীয়অর্থাৎ তুলনাহীন। জেমি বেল-এর টিনটিন যথেষ্ট ভাল, কিন্তু আরও অনেক ভাল হওয়ার সুযোগ আছে। স্নোয়ি প্রায় নিখুঁত। আরও মজার কাণ্ড পেলে অ্যান্ডি সার্কিসের হ্যাডক আরও জমিয়ে দেবে। সাইমন পেগ ও নিক ফ্রস্টের টমসনদ্বয়ের আরও কাজ চাই, না হলে ওদের ভুলের সংখ্যা ও দর্শকের হাসির মাত্রা বাড়বে কী করে? তবে ড্যানিয়েল ক্রেগ-এর সাখারিন এক কথায় অপূর্ব। তেমনি এক কথায় ‘অপূর্ব প্লাস’ বা ‘গ্রেট স্নেকস!’ হল জন উইলিয়ামসের সুরারোপ।
ওঁর সুরারোপই কেমন যেন মিলিয়ে দিল কমিক্স এবং সিনেমার জগৎকে।
ফিরে যাওয়া যায় গোড়ার প্রশ্নে। ছবির সাফল্যকে অভিবাদন জানিয়েই। সিনেমার কমিক্সকে কি কমিক্সের মতোই থাকতে হবে? সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান কমিক্সের সিনেমায়নে এ প্রশ্ন আমরা তুলি না। কিন্তু টিনটিন বা অ্যাস্টেরিক্সের ছবি হওয়ার সময় এ প্রশ্ন এসে পড়ে। কারণ সাহিত্য, ছবি এবং ছায়াছবির অফুরান সংস্রবে এই দুই মহৎ কমিক্সধারা সন্তর্পণে গড়ে উঠে প্রায় সিনেমার বিকল্প হয়ে উঠতে চেয়েছিল। তাতে যে তারা কী সফল তার প্রমাণ স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো এক জনকে এই কমিক্স সিনেমায় আনার প্রয়াস করতে হল। এবং সে-কাজে পূর্ণ সাফল্যের জন্য তাঁকে আরও কিছু অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমরা এটুকু জেনে আশ্বস্ত যে, তিনি আরও দু’টো টিনটিন ছবি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ।
স্পিলবার্গ সাহেবকে নম্বর দেওয়া আমার আয়ত্তের বাইরে। এটা অনেকটা ভগবানকে সদ্গুণের জন্য নম্বর দেওয়ার মতো। দিতে তো ইচ্ছে করে নয়, সাড়ে নয় (ওঁর ‘ইটি’কে তো দশে এগারোই দেওয়া যায় অনায়াসে)। কিন্তু এখনই হাত খালি করি কেন। তক্কে তক্কে আছি নয়, সাড়ে নয় দেওয়ার জন্যআগামী ছবিতে; অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে স্পিলবার্গেরও উন্নতি হওয়া সম্ভব। হাজার হোক, টিনটিনের কমিক্সকে তো দশে সাড়ে চুয়াত্তরের কম দেওয়া যায় না। |
|
|
|
|
|