অস্বস্তি ও ‘প্ররোচনা’ উপেক্ষা করে চিনকে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্কের বার্তাই দিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। দিল্লির চিন-নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে জানালেন, ভিন্নমতের বিষয়গুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে ‘হাতে হাত রেখে’ এগিয়ে যেতে কোনও বাধা নেই দু’দেশের।
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে পূর্ব এশিয়া শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে চিনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের সঙ্গে আজ বৈঠকে বসেন মনমোহন সিংহ। দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতীয় জাহাজের তেল সন্ধান নিয়ে বেজিংয়ের আপত্তিতে দু’দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। মনমোহনকে অস্বস্তিতে ফেলে ৫৫ মিনিটের এই বৈঠকে দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতীয় জাহাজ চলাচল নিয়ে আপত্তির কথা তোলেন ওয়েন। কিন্তু মনমোহন তাঁকে আশ্বস্ত করেন। জিয়াবাওকে বোঝান, ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানোর কোনও অভিপ্রায় দিল্লির নেই। নেহাতই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ভারতের জাহাজ ওই এলাকায় মোতায়েন হয়েছিল। চিনের প্রধানমন্ত্রীকে মনমোহন বলেন, শুধু ভৌগোলিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও পাশাপাশি রয়েছে দুই দেশ। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দু’দেশের এগিয়ে চলার অনেক সুযোগ রয়েছে। |
অরুণাচল বা লাদাখে মাঝেমাঝেই ঢুকে পড়ে বিস্কুট বা সিগারেট রেখে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায় চিনের সেনারা। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পাকা রাস্তা ও স্থায়ী পরিকাঠামো গড়ার অভিযোগও উঠছে তাদের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ চিন সাগরে ভিয়েতনাম উপকূলে ভারতীয় জাহাজের তেল সন্ধানেও বাগড়া দিতে ছাড়েনি বেজিং। এর পরেও ভারতীয় কূটনীতিকরা মনমোহন-ওয়েন বৈঠককে খুবই সফল বলছেন। বৈঠকের সুরকে ভারতের কূটনৈতিক জয় বলেও বর্ণনা করছেন। কারণটা কী?
আসলে পাকিস্তান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত দিল্লি আর কোনও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সংঘাত চায় না। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম এই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উত্তেজনার আঁচ পড়ুক, ভারতের তা কাম্য নয়। চিনের যাবতীয় প্ররোচনা ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করেই শান্তি বজায় রাখতে চায় দিল্লি। এটাই মনমোহন সরকারের চিন-নীতি। ভারতের এক কূটনীতিকের কথায়, চিনের সামরিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করাটা হঠকারিতা হবে। তারা যে সামরিক শক্তিতে ভারতের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে, এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায়ই নেই। তাই বেজিংয়ের সঙ্গে বিবাদ বাধিয়ে ভারতের কোনও লাভ নেই। উল্টে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক তপ্ত হলে পাকিস্তানই লাভবান হবে।
তা হলে চিনের প্ররোচনা কি দিল্লি সহ্যই করে যাবে?
বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার ব্যাখ্যা, আদৌ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে চিনের প্রভাব খর্ব করার জন্য ভারত পুরোদমে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া গিয়েছে। নেপালে ভারতের প্রভাব এখন আগের থেকে অনেক বেশি। ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের সঙ্গেও এখন দিল্লির সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ঘনিষ্ঠ। সম্প্রতি দিল্লি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সীমান্তে চিনা সেনারা প্ররোচনা দিলে তাদেরও যোগ্য জবাব দেওয়া হবে। এর জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এক লক্ষ বাড়তি সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করা হচ্ছে। সীমান্ত বরাবর পাকা রাস্তা ও ছাউনি তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রক বেশ কয়েকশো কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
বালিতে আজকের বৈঠকে চিনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন যে ভাবে দক্ষিণ চিন সাগরের বিষয়টি তোলেন, তাকে আর এক দফা প্ররোচনা বলেই মনে করছে বিদেশ মন্ত্রক। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় তার মোকাবিলা করে মনমোহন বার্তা দিয়েছেন সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের। শেষ পর্যন্ত সেই সুরই ধরে রাখা গিয়েছে বৈঠকে। এ ঘটনায় উত্তেজনা প্রশমনের ভারতীয় নীতিরই জয় হয়েছে বলে দাবি করছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের কথায়, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার কথা বলতে হয়েছে চিনের প্রধানমন্ত্রীকেও। ওয়েন জানান, দু’দেশের সীমান্তে যে ভাবে ‘শান্তি ও সৌহার্দ্য’ রয়েছে, বেজিংয়ের পক্ষে তা খুবই স্বস্তির। |