ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে আজ কূটনৈতিক ভারসাম্যের পথে হাঁটলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বালিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠকে তিনি স্পষ্ট জানালেন, পরমাণু চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত তার নিজস্ব আইন অনুযায়ীই চলবে। তবে ওই আইনে ক্ষতিপূরণের উর্ধ্বসীমা (পরমাণু দুর্ঘটনা হলে) ও অন্য কিছু শর্ত নিয়ে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা দূর করতেও যথাযথ ব্যবস্থা নেবে দিল্লি।
বালিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (আসিয়ান) শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি আজ ওবামার সঙ্গে এই পার্শ্ববৈঠকের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সেখানে জানিয়ে দেন, পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনের প্রশ্নে অনড় থাকবে ভারত। তাঁর কথায়, “আমি বারাক ওবামাকে বুঝিয়ে বলেছি যে, আমাদের দেশের নিজস্ব আইন রয়েছে এবং সেই মতো সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুন তৈরি হয়ে গিয়েছে।” তবে পাশাপাশি তিনি এ-ও জানিয়েছেন যে, পরমাণু চুক্তিটির বাস্তবায়নে যাতে কোনও সমস্যা না হয় সে দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। বস্তুত সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করেছে মনমোহন সরকার।
বিষয়গুলি নিয়ে গত বছর ভিয়েনায় একটি আন্তর্জাতিক আইনে (কনভেনশন অন সাপ্লিমেন্টারি কমপেনসেশন বা সিএসসি) স্বাক্ষর করেছে দিল্লি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সেটি দ্রুত অনুমোদন করবে বলে ওবামাকে আশ্বাস দিয়েছেন মনমোহন। এটা হলে মার্কিন সংস্থাগুলি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট রক্ষাকবচ পাবে বলেই মনে করছে বিদেশ মন্ত্রক। কেন-না, এর ফলে ভারত একটি আন্তর্জাতিক তহবিলের অংশীদার হবে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সেখান থেকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তাতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকবে না। |
তবে ভারতের পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনের অন্য যে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন বা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন তা হল, পরমাণু দুর্ঘটনার পরে যে কোনও সময় যে কোনও অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন ভারতের কোনও নাগরিক। এই অনিশ্চিত ঝুঁকির কারণেই মার্কিন ও অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, ভারতের পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যা মেনে নিয়ে বিনিয়োগ করা কার্যত অসম্ভব। এই পরিস্থিতি দূর করতে পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনের আওতায় নতুন একটি বিধি চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে। নয়া বিধিতে বলা হচ্ছে, দুর্ঘটনার পরে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সংস্থাটি যত বছরের জন্য লাইসেন্স পেয়েছে, কিংবা সংশ্লিষ্ট পণ্যের দায়ের মেয়াদ দু’টির মধ্যে যেটি বেশি হবে)। এবং এর অঙ্ক ১৫০০ কোটি টাকার বেশি হবে না। তবে পরমাণু-দ্রব্য সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গে এ ব্যাপারে আগে থেকেই চুক্তি করে রাখতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই এই বিধি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ কিছুটা কমাবে। তবে দেশীয় রাজনীতির চাপের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে মনমোহনকে। সরকার এই নয়া বিধি নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে গত ১১ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী ওবামাকে জানিয়েছেন, এই বিধি ৩০ দিন সংসদের বিবেচনাধীন থাকবে। তবে যা করার দেশের আইনের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই করতে হবে।
ঠিক এক বছর আগে দিল্লিতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন দুই রাষ্ট্রনেতা। তখনই ওবামা (পরমাণু দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে) সরবরাহকারী সংস্থার দেয় ক্ষতিপূরণের উর্ধ্বসীমা কমাতে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল, এই আইনটি প্রণয়ন করতে গিয়েই প্রচুর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়েছে মনমোহন সরকারকে। এখনও সরকার যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে রয়েছে দুর্নীতি-দমন ও অন্য বিভিন্ন প্রসঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার অনুরোধ মেনে আইন বদলাতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কের ঝড় তুলতে একেবারেই চাইছে না সরকার। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে মনমোহন ঘরোয়া রাজনীতির এই বাধ্যবাধকতার দিকটিও জানিয়েছেন মার্কিন নেতৃত্বকে। বুঝিয়েছেন, এই বিধি বদল নিয়েও কম ঝক্কি পোহাতে হবে না সরকারকে। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির এক মন্তব্যে তার আঁচও মিলেছে এ দিন। ইয়েচুরির অভিযোগ, “নয়া বিধিতে পাঁচ বছরের মধ্যেই দায়মুক্ত হয়ে যাবে পরমাণু-দ্রব্য সরবরাহকারীরা। এমন ছাড় দেওয়াটা খুবই গুরুতর বিষয়।
গত বছর নভেম্বরে ওবামার ভারত সফরের আগে প্রায় দু’মাস ধরে এই বিষয়গুলি নিয়ে উত্তাল ছিল দিল্লি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে প্রধানমন্ত্রীকে লোকসভায় বলতে হয়, “মার্কিন স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থেই বিলটি পাশ করাতে বাধ্য তাঁর সরকার। ইতিহাস এর বিচার করবে।” শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি মেনে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থার দায়বদ্ধতা আরও সুনিশ্চিত করা, (দুর্ঘটনা ঘটলে) ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের মাত্রা ৫০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১২০০ কোটি টাকা করা, পরমাণু জ্বালানি পরিবহণের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটলে সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও দায়ী করার মতো বিষয়গুলি আইনে রাখা হয়।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারত যে এই আইন আর পরিবর্তন করবে না, মার্কিন নেতৃত্বের সেটা অজানা ছিল তা নয়। আবার অসামরিক চুক্তিটির বাস্তবায়ন নিয়ে তেমন কোনও অনিশ্চয়তাও দেখছেন না তাঁরা। বিশেষ করে ভারত যেখানে বারবারই আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে যে, চুক্তিটি দিল্লি যথাসম্ভব দ্রুত বাস্তবায়িত করতে চায়। আসলে পরমাণু দায়বদ্ধতা আইনের পরিবর্তন নয়, মনমোহন মন্ত্রিসভা কবে ‘কনভেনশন অন সাপ্লিমেন্টারি কমপেনসেশন (সিএসসি)’-তে অনুমোদন দেবে, সেই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ওয়াশিংটন। যাতে নিজেদের স্বার্থ অটুট রেখেই ভারতে বিনিয়োগ করতে পারেন মার্কিন বিনিয়োগকারীরা।
পরমাণু প্রসঙ্গ ছাড়াও আফ-পাক পরিস্থিতি নিয়েও এ দিন বিশদে কথা হয়েছে দুই নেতার মধ্যে। ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পরে এই প্রথম ওবামার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন মনমোহন। আফগানিস্তানে শান্তি ফেরানো ও উন্নয়নের কাজে ভারত যে তার ভূমিকা আরও প্রসারিত করতে চায়, সে কথাও আমেরিকাকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমেরিকার বর্তমান পরিকল্পনা নিয়েও এ দিন কথা বলেছেন মনমোহন-ওবামা। |