|
|
|
|
মেয়েকে দেখতে দেবে কি পুলিশ, প্রশ্ন মায়ের |
সমীর দত্ত • বেলপাহাড়ি
দেবব্রত দাস • রানিবাঁধ |
আত্মসমর্পণ মানে কি মায়ের কাছে ফেরা? জানেন না জাগরীর মা। আট বছর ঘরছাড়া তাঁর মেয়ে। এ বার মেয়েকে একবার দেখতে চান গুরুবারি বাস্কে।
মা যতটা আকুল, ভাই ততটা নন। মাওবাদী দিদির জন্য বাড়িতে বহুবার পুলিশি হেনস্থা হয়েছে। দিদির উপর তাই তাঁর অনেক অভিমান। খানিকটা ক্ষোভও। ঘটনাচক্রে, বুধবারই তিনি পুলিশে চাকরির আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।
বস্তুত, বাড়ির মেয়ের মাওবাদী স্কোয়াডে থাকার জন্য পরিবারের উপরে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছে। পুলিশ বারবার এসেছে। জেরা করেছে। জাগরী বাস্কের আত্মসমর্পণ করার খবরে তাই খুব একটা ‘আবেগপ্রবণ’ হতে পারছেন না তাঁর ভাই শোভারাম। পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানায় বেলপাহাড়ির বকডোবা গ্রামের বাড়িতে এই যুবকের প্রতিক্রিয়া, “দিদি আট বছর আগে বাড়ি ছেড়েছে। এত দিন একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। তাই ভালমন্দ কিছুই আমার অন্তত মনে হচ্ছে না।” |
|
বকডোবা গ্রামের বাড়িতে জাগরীর মা, বাবা ও ভাই। বৃহস্পতিবার সৌরভ মোদকের তোলা ছবি। |
গুরুবারি বাস্কে অবশ্য মেয়েকে একবার চোখের দেখা দেখতে আকুল। বান্দোয়ানের গুড়পানায় সিআরপি শিবির থেকে জঙ্গলপথে প্রায় দু’কিলোমিটার হেঁটে সন্ধের মুখে পৌঁছনো গেল প্রত্যন্ত গ্রামটিতে। গ্রামের ‘বিবাগী’ মেয়ে যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তা তখনও জানা ছিল না তাঁদের। গ্রামে একটাই টিভি। ব্যাটারিতে চলত। বহুদিন হল খারাপ। আনন্দবাজারের কাছেই প্রথম শুনলেন তাঁরা।
খড় আর টালির ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসেছিলেন জাগরীর বৃদ্ধা মা গুরুবারি। মেয়েকে কি দেখতে ইচ্ছে করছে? বললেন, “আমি তো মা। আট বছর মেয়েকে দেখিনি। ওর সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করতে চাই। পুলিশ কি ব্যবস্থা করে দেবে?” সেই পুলিশ, যারা এই ক’বছরে জেরায় জেরায় পাগল করে দিয়েছে। বললেন, “একবার চোখ দেখাবে বলে পুলিশ কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল। তখন মেয়েকে নিয়ে এত প্রশ্ন করেছিলেন পুলিশকর্তারা যে, মনে হয়েছিল এর থেকে না এলেই বোধহয় ভাল হত।”
জাগরীর বাবা ঠাকুরদাস বাস্কে ততক্ষণে জমি থেকে ফিরেছেন। আত্মসমর্পণের খবর শুনে জানতে চাইলেন, “মেয়ে কি আমাদের কাছে ফিরবে? সেই আট বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কাঠ আনবে বলে। না ফেরায় খুবই দুশ্চিন্তায় থাকতাম। পরে শুনি ও বনপার্টিতে যোগ দিয়েছে।” জাগরীর দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শোভারাম বললেন, “দিদির জন্য পুলিশ বিভিন্ন সময়ে আমাদের বাড়িতে এসে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অত্যাচার করেছে।” তা হলে পুলিশেই চাকরির আবেদন কেন? জবাব এল, “পুলিশে চাকরি পেলে অন্তত সংসারটা বাঁচবে। ধানের জমি যা আছে, তাতে পেট চালানো মুশকিল।”
এর পরেই অভিমানটা বেরিয়ে এল ফের। তাঁর কথায়, “পুলিশ এসে বারবার জানতে চেয়েছে, দিদি টাকাপয়সা পাঠায় কি না। অথচ আজ পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাইনি দিদির কাছে। দিদি মাওবাদী। তাই সিপিএমও বাড়ি পোড়ানোর হুমকি দিয়েছিল। সেই ক’টা বছর খুব খারাপ কেটেছে।” একই সুরে স্থানীয় বাসিন্দা গুণারাম সরেন, চাঁদরা সরেনরা বলেন, “যে মেয়ের জন্য গ্রামে এত বার পুলিশ এসেছে, হেনস্থা করেছে, তাকে নিয়ে আমরা কেন ভাবব?”
বকডোবায় তবু লোকে কথা বলেছে। রানিবাঁধ ব্লক সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম মিঠাআমের বাসিন্দারা তো এ দিন মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। গ্রামের ছেলে রাজারাম সোরেন যে আত্মসমর্পণ করেছে, তা তত ক্ষণে জেনে গিয়েছেন গ্রামবাসীরা। বিকেলে যখন মিঠাআম মোড়ে পৌঁছনো গেল, মুহূর্তের মধ্যে গোটা এলাকা চুপ। চায়ের দোকানে বসে থাকা যুবকেরা কিছু বলতে চাননি। রাজারামের বাড়ি কোন দিকে জানতে চাওয়ায় ইশারায় দেখিয়ে দিলেন।
দোকানের কাছেই মাটির বাড়ি। খড় ও টালির ছাউনির বাড়িটাতে তালা ঝুলছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানালেন, রাজারামের বাড়িতে এক ভাই তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন। পাশের ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা। কাউকেই পাওয়া গেল না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন জানালেন, ১৯৯৮ সাল নাগাদ রাজারাম ‘বনপার্টি’র সঙ্গে গ্রাম ছাড়েন। সন্ধ্যায় কোনও ভাবে মোবাইলে যোগাযোগ করা গেল রাজারামের ভাই লক্ষ্মী সোরেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, “২০০৫-এর শেষে একবার দাদা এক রাতের জন্য বাড়ি এসেছিল। দাদাকে বলেছিলাম, ও-সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে আয়। দাদা বলেছিল, ‘এখন আর ফেরা যাবে না। কোনও দিন পারি তো ফিরব। তোরা ভাল থাকিস’।” এর পরে আর যোগাযোগ হয়নি। লক্ষ্মীর কথায়, “শুনলাম, দাদা আত্মসমর্পণ করেছে। ও যদি সুস্থ জীবনে ফিরে আসে, বাবা-মা সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। বাবা সব সময়েই বলেছে, ওদের সঙ্গে থাকাটা ভাল নয়। গ্রামের মানুষও দাদার জন্য আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। পুলিশও এসেছে কয়েক বার।” এই একটা জায়গায় বড্ড মিল বকডোবা আর মিঠাআমের। দুই পরিবারকেই ঘিরে ছিল সন্দেহ আর অবিশ্বাস। এ বার মুক্তি হল কি না, বলবে ভবিষ্যৎ। |
|
|
|
|
|