পশ্চিমবঙ্গের জেলখানাগুলিতে বিচারাধীন বন্দিদের আন্দোলন ক্রমে ছড়াইয়া পড়িতেছে। হয় দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা হোক, নতুবা জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক এই দাবিতে বন্দিরা জেলে জেলে আমরণ অনশন শুরু করিয়াছেন। জেল-কর্তৃপক্ষ দিশাহারা। অনশনে অসুস্থ হইয়া বন্দিদের মৃত্যু হইলে তাহার দায় অংশত হইলেও কারা-প্রশাসনের উপরে বর্তাইবে। রাজ্যের আইন ও বিচার মন্ত্রকের উপর দায় বর্তাইবে সর্বাধিক। কেননা বিচারাধীন বন্দিদের যথাসময়ে আদালতে হাজির করানো এবং মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তির তদারকি তাহাদেরই করার কথা। সরকারি আইনজীবীদের বেতন-ভাতাও তো জনসাধারণের দেওয়া তহবিল হইতেই বিতরিত হয়। সমস্যাটি নূতন নয়। কিন্তু নূতন সরকারকে ইহার সমাধানের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইতে হইবে।
ন্যায়বিচার পাওয়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কারাবন্দিদেরও সে অধিকার পূর্ণ মাত্রায় রহিয়াছে। কারাবন্দিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই বছরের পর বছর কার্যত বিনা বিচারে জেলে পচিতেছেন। মাঝে-মধ্যে ‘দিন’ পড়িলে তাঁহাদের আদালতে শুনানির জন্য লইয়া যাওয়া হয়। আবার একটি দিন ধার্য করিয়া পুনরায় কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। সাক্ষী হাজির হয় নাই কিংবা বাদী বা বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর সর্দি হইয়াছে, এমন অজুহাতেও শুনানি ও বিচার বিলম্বিত হয়। কিছু বন্দি আছেন যাঁহাদের ‘অপরাধ’-এর সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ পার হইয়া গেলেও এখনও বিচারের প্রক্রিয়া সাঙ্গ হয় নাই বলিয়া অনর্থক তাঁহাদের আটকাইয়া রাখা হইয়াছে। প্রতিবেশীর মুরগি চুরির মতো অপরাধে বছরের পর বছর জেল খাটিতেছেন, এমন বন্দির সংখ্যা কম নয়। আর একটা বড় অংশ বন্দি রহিয়াছেন জামিন বাবদ দেয় অর্থ আদালতে জমা দেওয়ার সঙ্গতি নাই বলিয়া। এ সবই বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার শামিল। সংবিধান কিন্তু বন্দিদের সহিত এমন অমানবিক আচরণে উৎসাহ দেয় না। রাজ্য সরকার যখন জেলখানাকে কারাগার না বলিয়া সংশোধনাগার আখ্যা দেন, তখন তাহার পিছনেও বন্দিদের প্রতি এমন অমানবিক ঔদাসীন্যের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পত্রপাঠ চার্জশিট দাখিল করিয়া তাঁহাদের আদালতে হাজির করানোর দায় রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের। অতঃপর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলি চালাইয়া দ্রুত সেগুলির নিষ্পত্তির জন্য তৎপর হওয়ার দায়ও রাজ্যের আইন ও বিচার মন্ত্রক এবং তাহার অধীন সরকারি আইনজীবীদের। সেই দায়িত্বগুলি সঠিক ভাবে পালিত হইলে আজ রাজ্যের কারাগারগুলি এমন উপচাইয়া পড়িত না।
সত্য, আদালতের তরফেও কিছু সমস্যা আছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক না থাকা, সর্ব স্তরের আদালতেই বহু বিচারপতির পদ শূন্য থাকার ফলে অনেক বন্দির মামলাই আদালতে উঠিতে পারে না, উঠিলেও দীর্ঘ কাল ঝুলিয়া থাকে। এ ক্ষেত্রে বন্দিদের মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তির দায় বিচারবিভাগের। শূন্য পদ পূরণ, আদালতের দীর্ঘকালীন ছুটি সঙ্কুচিত করা, প্রয়োজনে অবসরকালীন আদালত বা বেঞ্চ গঠন, মামুলি অভিযোগের দীর্ঘমেয়াদি শুনানিতে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট না করিয়া বিচারের জন্য সেগুলিকে লোক-আদালতে পাঠানো নানা ভাবেই আদালতের বোঝা কমানো যায়। এ ব্যাপারে রাজ্যের আইন ও বিচার মন্ত্রককেও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করিতে হইবে। জামিনের টাকা না দিতে পারিয়া যাঁহারা জেলখানায় আটক, তাঁহাদের দেয় টাকা প্রয়োজনে রাজ্য সরকার দিয়া দিক। মনে রাখা দরকার, জামিন-অযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত নয়, এমন সকলেরই জামিনে মুক্তি পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রহিয়াছে। দারিদ্রের কারণে সেই টাকা দিতে না-পারাটা তাঁহাদের দোষ তত নয়, যতটা দারিদ্র দূরীকরণে দায়বদ্ধ নির্বাচিত সরকারের। অচিরে জামিনযোগ্য অপরাধীদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হোক। অন্যদের মামলাগুলিও অনন্ত কাল ঝুলাইয়া না রাখিয়া দ্রুত নিষ্পন্ন করা হোক। |