সংসদে বিরোধী ঐক্য বজায় রেখেই সরকার-বিরোধিতার রাশ ফের নিজেদের হাতে রাখতে তৎপর হল বিজেপি। তাই দুর্নীতির মতো বিষয় নিয়ে শুধু বিতর্কে সম্মতি দিয়ে বামেদের সুরে সুর মিলিয়ে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাবে রাজি হল কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দল।
সংসদের গত বাদল অধিবেশনে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের ‘আঁতাঁত’-এর অভিযোগ তুলেছিলেন বামেরা। আজ স্পিকারের ডাকা সর্বদল বৈঠকে বাসুদেব আচারিয়া, গুরুদাস দাশগুপ্তের মতো বাম নেতারা লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজকে জানিয়ে দেন, তাঁরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সংসদের প্রথম দিনেই মুলতুবি প্রস্তাব আনতে চান। গত অধিবেশনে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রস্তাব এনেছিল বিজেপি। কিন্তু বামেদের অভিযোগ, সেই প্রস্তাব এমন ভাবে তৈরি হয়েছিল, যাতে সরকারের উপরে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনও দায়বদ্ধতা না চাপে। তাই সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে নিস্তার পাননি সাধারণ মানুষ। এই প্রসঙ্গ টেনে সুষমাকে কটাক্ষ করে বাম নেতারা বলেন, এ বারেও বিজেপি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করুক, এই বিষয়ে তারা কী অবস্থান নেবে। মুলতুবি প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকার নমনীয় না হলে সংসদ না চলার পরিস্থিতিই তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বামেদের এই কটাক্ষের পরে মধ্যাহ্নভোজের সময় তাঁদের কাছে এসে সুষমা জানান, এ বার সরকারের সঙ্গে বিজেপি কোনও সমঝোতা করবেন না। বরং বামেদের সঙ্গে আলোচনা করেই যাবতীয় রণকৌশল স্থির করা হবে। সুষমা নিজেও পরে সাংবাদিকদের বলেন, “বাম-সহ সব দলের সঙ্গেই আলোচনা করা হবে। আগামী সোমবার এনডিএ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দলের কৌশল নির্ধারণ করা হবে।” পরে বিজেপির মুখপাত্র নির্মলা সীতারামণ বলেন, “অর্থনীতির সামগ্রিক হাল নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্তই নিয়েছে দল।” একই ভাবে বামেরাও অর্থনীতির এই ‘সামগ্রিক’ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা চাইছিল। মূল্যবৃদ্ধি তো বটেই, সেই সঙ্গে পেট্রোপণ্যের লাফিয়ে দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক কারণ দায়ী, না দেশের ভ্রান্ত অর্থনীতি তা নিয়েও বামেরা আলোচনার পক্ষপাতী।
কিন্তু বামেদের সুরে সুর মিলিয়ে বিরোধী ঐক্য বজায় রাখতে গিয়ে বিজেপি মূল্যবৃদ্ধি-প্রসঙ্গে যতটা গুরুত্ব দিল, দুর্নীতির মতো বিষয়কে কিন্তু ততটা গুরুত্ব দিতে পারল না তারা। অথচ আজই বিজেপি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেছে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা ‘সফল’। যাত্রাপথে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আর ভোট-ঘুষ কাণ্ডে যে বিজেপির সদস্যরা কারাবন্দি হওয়ার পরে আডবাণী রথযাত্রার ঘোষণা করেছিলেন, আজই তাঁরা তিহাড় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। স্বভাবতই উল্লসিত বিজেপির তরফে আজ সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করা হয়, আদালত তাদের যাবতীয় যুক্তি মেনে নিয়েছে। ফলে যত দিন না ভোট-ঘুষ কাণ্ডে প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে এবং বিজেপি সদস্যরা সদস্যরা নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন, তত দিন আদালতের ভিতরে-বাইরে তাদের আন্দোলন চলবে।
এই পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাবে সায় দিয়েও দুর্নীতি ও কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে শুধুমাত্র বিতর্কের ব্যাপারেই সম্মত হয়েছে বিজেপি। এই ব্যাপারে তারা নোটিসও দিয়েছে। বামেরা কমনওয়েলথ গেমস, কে জি বেসিন, লোকপাল নিয়ে আলোচনার সময় দুর্নীতি প্রসঙ্গ তুলতে চান। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও ফের সরব হবেন বামেরা। সে ক্ষেত্রে বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরার আশঙ্কাও রয়েছে। সেই কারণে আপাতত মূল্যবৃদ্ধি ও সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী ঐক্য সুনিশ্চিত করে ধীরে ধীরে এগোতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
দলের এক শীর্ষ নেতার জানান, আডবাণীর রথযাত্রার সাফল্যকে পুঁজি করে সংসদে সরব হওয়ার কৌশল নেওয়া হচ্ছে। মনমোহন সিংহের পাশাপাশি সনিয়া গাঁধীকেও রাখা হবে আক্রমণের লক্ষ্যে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে দুর্বল করতে অন্যান্য বিরোধী দল এমনকী সরকারের শরিক দলগুলিরও সমর্থন প্রয়োজন। সেই রাশটি বিজেপি নিজের হাতেই রাখতে চায়। মূল্যবৃদ্ধি আম-আদমির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত। ফলে সংসদের গোড়ায় সেই বিষয়ে সরব হলে কোনও লোকসান নেই। তবে পরে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিজেপি নিজেদের রণকৌশল স্থির করবে। |