রোগী এলেই ‘রেফার’, ধুঁকছে মহকুমা হাসপাতাল
হাসপাতালে রোগী আসছে অনবরতই। আর ‘রেফার’ও হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। শিল্পশহর হলদিয়ার মহকুমা হাসপাতালের এমনই হাল! ১৯ একর জমির উপর দ্বিতল-ভবন নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের প্রেত। ‘নেই’-এর তালিকা এতই দীর্ঘ, কহতব্য নয়। পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েছেই, সবচেয়ে বড় সমস্যা চিকিৎসকও প্রায় নেই বললেই চলে।
শূন্যপদে দীর্ঘ দিন নিয়োগ হয়নি মেডিসিনের ডাক্তার। ফলে খোলা হয় না ওই বিভাগের আউটডোর। নেই জরুরি বিভাগ সামলানোর জন্য ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারও। জরুরি বিভাগের জন্য জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারের প্রয়োজন ১৫ জন। সে ক্ষেত্রেও রয়েছেন মাত্র ৫ জন। তাঁদের মধ্যে আবার গরহাজিরার অসুখ। এক কর্মীর কথায়, “দু’জন চিকিৎসকের বাড়ি কলকাতায়। হলদিয়ায় সপ্তাহের ছ’দিন থাকার কথা থাকলেও তাঁরা থাকেন না। যে দিন রাতে আসেন সে দিনই ‘নাইট ডিউটি’ করে তাঁর পরের দিন ‘মর্নিং ডিউটি’ ও একই সাথে বহির্বিভাগে ডিউটি সেরেই বা বড়জোর সে দিন থেকে পরের দিনই চলে যান।” হাসপাতাল সুপার হারধন বর্মনও স্বীকার করেছেন এই অভিযোগ। তাঁর বক্তব্য, “ওনাদের সবাইকেই আমি বার বার বলি। কিন্তু একে আমাদের চিকিৎসকের অভাব। তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করলে ওঁরাও চলে যেতে পারেন। তাই বেশি বলতে পারি না।” রোগীকে ২৪ ঘণ্টা ‘অবজার্ভেশন’-এ রাখার মতোও পরিকাঠামো নেই। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও রোগী এলেই তৎক্ষণাৎ ‘রেফার’ করে দিচ্ছেন জেলাসদর তমলুকে কিংবা কলকাতার হাসপাতালে। অথচ এক কালে এই হাসপাতালেই সমীর রায়, প্রশান্ত সিংহদের মতো চিকিৎসকদের সুচিকিৎসার কথা আজও মুখে মুখে ফেরে।
মহকুমা হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী ৩০০টি শয্যার বদলে এমনিতেই রয়েছে ১৮৮টি শয্যা। ডাক্তারের অভাবে সেই শয্যারও সিংহভাগই খালি থাকে। মহকুমা হাসপাতালের তকমা থাকলেও সাধারণ বহির্বিভাগে (জেনারেল আউটডোর) প্রতি দিনের পাঁচশো রোগীর জন্য কার্যত এক জন ডাক্তারও নেই। অথচ অন্তত দু’জন চিকিৎসক প্রয়োজন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন এক জন। সম্প্রতি তিনিও অবসর নিয়েছেন। ফলে এই বিভাগে রোগীরা ন্যূনতম চিকিৎসা-পরিষেবাও পাচ্ছেন না। রেডিওলজি বিভাগে ৩ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন থাকলেও রয়েছেন এক জন। তিনিই মাঝেমধ্যে ছুটে যান জরুরি-বিভাগে, সেখান থেকে ফের ‘ওয়ার্ড রাউন্ডে’। ওই চিকিৎসক নীলাঞ্জন চক্রবর্তীর অভিযোগ, “আমাকে সপ্তাহে ৯ ঘণ্টা শুধুমাত্র জরুরি-বিভাগে কাজ করতে হচ্ছে। এ ছাড়াও অন্য বিভাগও সামলাতে হচ্ছে। ভাবুন, এ বার আমার বিভাগ কী ভাবে চলবে?” একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি গোটা হাসপাতালে।
অবস্থা করুণ শিশু-বিভাগেও। ৪ জন শিশু বিশেষজ্ঞের বদলে রয়েছেন মাত্র এক জন। এই বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার সুজন জানাকেই সামলাতে হয় প্রতি দিন প্রায় তিনশো শিশুকে। আবার প্রসূতি বিভাগের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর উপরেই বর্তায়। অভিযোগ, এই পরিস্থিতিতে ছেলেভুলানো চিকিৎসা ছাড়া আর কিছুই সম্ভব নয়। সুজন জানার বক্তব্য, “হাসপাতালের দুর্দশা স্বীকার করা ছাড়া গতি নেই। চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত তো হচ্ছেই।” স্ত্রীরোগ বিভাগে ৪ জন চিকিৎসক থাকার কথা। রয়েছেন দু’জন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র এক জন। যদিও ৩ জন থাকা প্রয়োজন। ফলে চক্ষু-বিভাগে অপারেশন বন্ধ প্রায় সাত মাস।
স্থানীয় বাসিন্দা এমদাদুল ইসলামের বক্তব্য, “এতবড় একটা মহকুমা হাসপাতাল পুরোপুরি হাতগুটিয়ে বসে রয়েছে সবাই। সব জেনেও হাল ফেরাতে কারও উদ্যোগ নেই।” মহকুমা হাসপাতাল-ফেরৎ রোগী আশিস ধাড়ার স্ত্রী কৃষ্ণা ধাড়ার কথায়, “আমার স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এখানে চিকিৎসা না পাওয়ায় নিয়ে যেতে হচ্ছে তমলুক হাসপাতালে। জানি না সেখানেও চিকিৎসা হবে কি না!’’ প্রাক্তন স্বাস্থ্যকর্মী তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা রথীন মান্নার আবার অভিযোগ, “বাম আমলের লোকেরা এখনও অনেকে স্বাস্থ্যভবনে বসে আছে। ঘুঘুর বাসা পুরো ভাঙেনি বলেই এই অবস্থা। আমাদের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য হাল ফেরাতে বহু চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছে না।” হাসপাতাল সুপার হারাধন বর্মনের অকপট স্বীকারোক্তি, “আমাদের হাসপাতালের পরিস্থিতি কী যে করুণ তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। জেলার কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’জন করে চিকিৎসক থাকলেও এখানে পাঠানো হচ্ছে না।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুকুমার দাসের অবশ্য বক্তব্য, “আমার যতটুকু করার করছি। জেলার কোথাও অতিরিক্ত চিকিৎসক নেই যে হলদিয়ায় পাঠাব। আমি স্বাস্থ্য ভবনে বিষয়টি জানিয়েছি। দেখা যাক কী হয়।”
শিল্পশহরে সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটে চলে নিয়মিতই। অথচ ১৯৮৬ সালে তৈরি হওয়া এই হাসপাতালে নেই ট্রমা সেন্টার বা ভেন্টিলেশন ইউনিট। চালু করা যায়নি বার্ন ওয়ার্ড। এমনকী হাসপাতালে সাত বছর ধরে নেই কোনও আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিন। তিনটি এক্স-রে মেশিনের দু’টিই বিকল। নিজস্ব জেনারেটর থেকেও ভাড়া করতে হচ্ছে বাইরের জেনারেটর। এই পরিস্থিতির কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী স্বাস্থ্য দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি সঞ্জয় মিত্রকে জানালেও এখনও বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থার মাঝে চলছে হলদিয়া মহকুমা হাসপাতাল।
কবে হাসপাতালের হাল ফিরবে, তারই অপেক্ষায় দিন গুনছেন হলদিয়া মহকুমার মানুষ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.