ওঁরা বলছেন, এত কম লোকবল নিয়ে পরিষেবা ঠিক রাখা কঠিন। ওঁদের এ-ও আক্ষেপ, কথায়-কথায় গাফিলতির অভিযোগে ডাক্তারদের মার খাওয়াটা যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে!
আর এই দুই ‘কারণ’ দেখিয়ে সরকারি চাকরি ছাড়তে চাইছেন নবীন-প্রবীণ দুই প্রজন্মের অনেক চিকিৎসক। এক দিকে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়ে সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ)-এর কাজে যোগ দিতে কিছু নবীন চিকিৎসক অনীহা প্রকাশ করেছেন। অন্য দিকে সীমিত পরিকাঠামোয় উন্নত পরিষেবা দেওয়া এবং রোগী রেফার কমানোর ‘সরকারি চাহিদা’ পূরণে অক্ষমতা জানিয়ে বিভিন্ন জেলায় স্বেচ্ছাবসর নিতে চাইছেন বেশ কিছু প্রবীণ সরকারি চিকিৎসক।
ফলতই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন সঙ্কটে পড়েছে রাজ্য সরকার।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যাঁদের ডাক্তার করে তুলতে পড়াশোনার ৯০% ব্যয়ভার সরকার বহন করে থাকে, তাঁরা কেন সরকারি পরিষেবা দিতে দায়বদ্ধ থাকবেন না? কেন তাঁরা কাজ করবেন না সরকারি হাসপাতালে? না-করলে তা বাধ্যতামূলক করতে কোনও আইন প্রণয়নই বা করা হবে না কেন, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য-কর্তা থেকে মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের অনেকেই সরকারি কাজে চিকিৎসকদের দায়বদ্ধ করতে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছেন।
পাশাপাশি অন্য রকম পরামর্শও মিলছে। যেমন রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার দিলীপ ঘোষের প্রস্তাব, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে নবাগত পড়ুয়াদের মধ্যে কারা পাশ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে জেলায় কাজ করতে ইচ্ছুক, তা আগে জেনে নিয়ে শুধু তাঁদেরই পড়ার খরচ জোগানো হোক। যাঁরা ওই মর্মে হলফনামা দেবেন না, তাঁদের নিজেদের খরচে পড়তে হবে। এতে কোষাগারে সাশ্রয়ের সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারের জোগানও নিশ্চিত করা যাবে বলে তিনি মনে করেন। |
রাজ্য সরকার কী বলছে?
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করেনি। তবু লাভ হয়নি। তাঁর কথায়, “আমরা যখন এই পেশায় ঢুকেছিলাম, তখন অন্তত পাঁচ বছর গ্রামে কাজ করার জন্য বন্ড সই করতে হতো। পরে আইনের সাহায্যে বেশ কিছু ডাক্তার এই নিয়ম গলে বেরিয়ে গেলেন। কোর্ট বলল, সরকার খরচ দিচ্ছে বলেই চিকিৎসকদের ‘ক্রীতদাস’ করে রাখা যায় না!”
সরকারি সুযোগ নিয়ে সরকারকেই অসুবিধায় ফেলার মাসুল আদায়ের একটা ব্যবস্থা স্বাস্থ্য দফতরে অবশ্য রয়েছে। মেডিক্যালে স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ পেয়েও কেউ ভর্তি না-হলে একটি আসন নষ্ট করার জন্য সরকার ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ নেয়। যদিও এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে। উপরন্তু আসন ছাড়লেও অনেক ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী টাকা আদায় করা যায় না।
এখন প্রশ্ন, ক্ষতিপূরণের সংস্থান শুধু স্নাতকোত্তরে সীমাবদ্ধ না-রেখে মেডিক্যালের সর্বস্তরে বলবৎ হবে না কেন? যে প্রসঙ্গে চিকিৎসকদের পাল্টা প্রশ্ন, ‘দায়বদ্ধতা’র ভার শুধু তাঁদের উপরে চাপানো হবে কেন? ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কেন দায়বদ্ধ থাকবে না? যার উত্তরে স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র অভিযোগের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকদের দিকেই। কী রকম?
সচিবের বক্তব্য, “বারবার বলা হয়েছে, ডাক্তারেরা যেন হাসপাতালে আইডেন্টিটি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে রাখেন, নির্দিষ্ট পোশাক পরে থাকেন। কেন করেন না? সেই জন্যই তো বোঝা যায় না, কে ডাক্তার আর কে বাইরের লোক! প্রচুর লোক ইমার্জেন্সিতে ঢুকে সহজেই ডাক্তারদের মারধর করতে পারে।” স্বাস্থ্য-সচিবের মন্তব্য, “দফতর ডাক্তারদের নিরাপত্তা দেয় না, এই অভিযোগ বাহানামাত্র। চিকিৎসক নিগ্রহের সমস্ত ঘটনায় দোষী গ্রেফতার হয়েছে।” এর প্রতিক্রিয়ায় জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের মন্তব্য, “চেম্বারে, ইমার্জেন্সিতে, এমনকী ওটি-তে ঢুকে পেটাচ্ছে! আই-কার্ড বা অ্যাপ্রন কি বাঁচাতে পারবে?”
নিরাপত্তা ঘিরে এই চাপান-উতোরের সূত্রেই আসছে পরিকাঠামোয় ‘ঘাটতি’র প্রসঙ্গ।
চিকিৎসক মহলের একাংশের অভিযোগ: গ্রামের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, খাস কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলোতেই হামেশা গজ-ব্যান্ডেজ-স্পিরিটও পাওয়া যায় না। এক চিকিৎসকের ক্ষোভ, “ইমার্জেন্সিতে সঙ্কটাপন্ন রোগী ছটফট করেন, আমাদের কিছু করার থাকে না। অথচ রোগীর বাড়ির লোককে জিনিসগুলো কিনে আনতে বললে তাঁরা আমাদের উপরে চড়াও হন।” কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের এক জুনিয়র ডাক্তারের প্রশ্ন, “সরকার ডাক্তারদের দায়বদ্ধতা নিয়ে সরব। কিন্তু নিজেদের কাজটা তারা ঠিকঠাক করছে কি? ন্যূনতম পরিকাঠামো না-পেলে আমাদের তো মারই খেয়ে যেতে হবে।” চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর রাজ্য সভাপতি মলয় পাত্রও বলেন, “আগে জেলা বা গ্রামে ডাক্তারি করার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়তে হবে। নচেৎ শত নিয়ম করেও ডাক্তার মিলবে না।”
রাজ্যের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী, মেডিকো-লিগ্যাল বিশেষজ্ঞ নিশীথ অধিকারী অবশ্য মনে করছেন, রাজ্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করলেই সমস্যা মিটে যায়। নিশীথবাবুর মতে, “সরকার যখন ডাক্তার বানাতে এত টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে, তখন ভর্তির আগে হবু চিকিৎসকদের কিছু শর্ত দেওয়াই যেতে পারে। এ জন্য আইন করতে হবে।” রাজ্য নিজে থেকে এমন আইন প্রণয়নে রাজি না-হলে এ ব্যাপারে কেউ জনস্বার্থ-মামলাও করতে পারেন বলে জানিয়েছেন নিশীথবাবু।
অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, বিতর্ক, পরামর্শ তো আছেই। কিন্তু বর্তমান সঙ্কটের সুরাহা কী ভাবে হবে?
এসএনসিইউয়ে কাজ করতে অনাগ্রহী নবীন চিকিৎসক এবং জেলা হাসপাতালে থাকতে না-চাওয়া প্রবীণ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এখনই কোনও কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। চিকিৎসকের ‘দায়বদ্ধতা’ সুনিশ্চিত করতে কোনও বিশেষ পদক্ষেপও করছে না। বরং ডাক্তারদের সুযোগ-সুবিধে বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, এসএনসিইউয়ের চিকিৎসক পদ ‘নন-প্র্যাক্টিসিং’ হলেও মূল বেতনের ৩০% অতিরিক্ত ভাতা হিসেবে দেওয়া হবে। জেলায় যে সব হাসপাতালে রোগীর চাপ অত্যন্ত বেশি, সেখানে প্রবীণ চিকিৎসকদের পারফরম্যান্স-ভিত্তিক ভাতা দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। |