যক্ষ্মা নির্মূল করার লক্ষ্যে এক বড় বাধা ডিঙোলেন এক দল ভারতীয় বিজ্ঞানী। কলকাতা ও দিল্লির দুই গবেষণাগারে মিলল এমন একটি প্রশ্নের উত্তর, গত নয় দশক ধরে যা ভাবাচ্ছিল বিশেষজ্ঞদের। ভাবাবেই, কারণ, সমীক্ষা বলছে, পুরোদস্তুর রোগগ্রস্ত না হলেও পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষই যক্ষ্মার জীবাণুতে আক্রান্ত। আর, সেই জীবাণুর কোপেই ফি বছর প্রাণ হারান প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ।
অথচ এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছিল সেই ১৯২১ সালে, এ পর্যন্ত যা প্রায় ৩০০ কোটি মানুষকে দেওয়া হয়েছে। তবু কেন নির্মূল হল না যক্ষ্মা? এর উত্তর যাঁরা খুঁজে পেয়েছেন, তাঁরা হলেন দিল্লিতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির গোবর্ধন দাস, শমিত চট্টোপাধ্যায়, বেদপ্রকাশ দ্বিবেদী, যোগেশ সিংহ, পবন শর্মা ও ইমরান সিদ্দিকি এবং কলকাতায় আই ডি অ্যান্ড বি জি হাসপাতালের দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের গবেষণার সাফল্য বিস্তারিত ভাবে স্থান পেয়েছে সদ্য প্রকাশিত ‘প্লস প্যাথোজেন’ জার্নালে। নিজেদের কাজের বর্ণনা দিয়ে তাঁরা যে পেপার লিখেছেন, তার শিরোনাম ‘আর্লি সিক্রিটেড অ্যান্টিজেন ইস্যাট-সিক্স অফ মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস প্রোমোটস প্রোটেক্টিভ টি হেল্পার সেভেন্টিন সেল রেসপন্সেস ইন আ টোল-লাইক রিসেপটর-টু-ডিপেন্ডেন্ট ম্যানার’।
যক্ষ্মার টিকা আবিষ্কার করছিলেন দুই ফরাসী বিজ্ঞানী। আলবের কালমেৎ এবং কামিই গের্যা। যক্ষ্মার জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস-কে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করে তৈরি হয় বলে ওই প্রতিষেধকের নাম ব্যাসিলাস কালমেৎ গের্যা।ঁ সংক্ষেপে বিসিজি। সমীক্ষা বলছে, ফুসফসের যক্ষ্মা রোধে বিসিজি-র সাফল্যের হার ৮০ থেকে ০ শতাংশ। অর্থাৎ শৈশবে বিসিজি দেওয়া হলেও বড় হয়ে তাদের শতকরা ২০ জনের ক্ষেত্রে ফুসফুসের যক্ষ্মা অবশ্যই হবে। ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে হতে পারে ১০০ জনেরও। |
বিসিজি-র দুর্বলতাটা কোথায়? মানবদেহে বিসিজি-র কাজ ‘টি হেল্পার-ওয়ান (টিএইচ-১)’ নামে এক জাতের কোষকে উদ্দীপিত করা। ওই উদ্দীপিত কোষ যক্ষ্মার জীবাণুকে পর্যুদস্ত করতে বড় ভূমিকা নেয়। কিন্তু ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে গোবর্ধন-দেবপ্রসাদরা দেখেছেন, ‘টিএইচ-১’-কে উদ্দীপিত করলেও বিসিজি ফুসফুসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ কোষ ‘টি হেল্পার সেভেনটিন (টিএইচ-১৭)-কে যক্ষ্মার জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামাতে পারে না। ‘টিএইচ-১৭’ অথর্ব থাকে বলেই বহু মানুষের ফুসফুসে জাঁকিয়ে বসে যক্ষ্মা।
বিসিজি কেন পারে না ‘টিএইচ-১৭’-কে জাগাতে? পরীক্ষায় তা-ও জেনেছেন গোবর্ধন-দেবপ্রসাদরা। দেখেছেন, প্রতিষেধকটি তৈরির সময় যক্ষ্মার জীবাণুকে কিঞ্চিৎ নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়ায় বিসিজি হারিয়ে ফেলে ‘ইস্যাট-৬’ নামে গুরুত্বপূর্ণ এক প্রোটিন। যার কাজই হল ‘টিএইচ-১৭’-কে জাগানো। ইস্যাট-৬ হারিয়ে সেই কাজটা আর করতে পারে না বিসিজি। অর্থাৎ গোবর্ধন-দেবপ্রসাদদের গবেষণায় স্পষ্ট, বিসিজি-তে ইস্যাট প্রোটিন অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলেই এই টিকা ফুসফুসের যক্ষ্মা প্রতিরোধে ১০০ ভাগ সফল হবে।
বর্ধমানে নিমদহ গ্রামের ছেলে গোবর্ধন এই গবেষণা নিয়ে যথেষ্ট উৎফুল্ল। বিশ্বভারতীর ছাত্র, গবেষণা করছেন আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং টিকা তৈরিতে বিশ্বের প্রথম সারির এক বহুজাতিক সংস্থায়। দিল্লি থেকে ফোনে গোবর্ধন বললেন, “আমাদের সাফল্যে আকৃষ্ট হয়েছেন আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। ওঁরা এ বার বাঁদরের উপর গবেষণা করবেন।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেবপ্রসাদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে গবেষণা করতেন লন্ডনে। এখন কলকাতায় সংক্রামক ব্যাধির হাসপাতালে। বললেন, ‘‘টিকার মধ্যে ওই বিশেষ প্রোটিনটি রাখা কঠিন কাজ নয়। যক্ষ্মা কেন নির্মূল হবে না?” গোবধর্ন-দেবপ্রসাদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত এ শহরের বিশেষজ্ঞরাও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মনিদীপা সেনগুপ্ত বললেন, “কাজটি রীতিমতো ভাল মানের। অপেক্ষা করব বাঁদর বা ওই জাতের প্রাণীদেহে এ রকম গবেষণার উপর।” পিয়ারলেস হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শতদল দাস বললেন, “ফুসফুসে যক্ষ্মা প্রতিরোধে বিসিজি-র ব্যর্থতা আমাদের বহু কালের চিন্তার বিষয়। গোবর্ধন-দেবপ্রসাদের সাফল্য নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।” |