এ হেন অপবাদ, তাও কি না চিরশত্রু মহম্মদ আলি-র মুখে! বর্ণবৈষম্যের গতি বিচিত্র। কে-ই বা জানত, ‘আঙ্কল টম’ হয়ে উঠবে কুৎসিত গালি! এমন তুমুল নাটক নিয়েই জো ফ্রেজিয়ারের জীবন। লিখছেন
অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
সেপ্টেম্বর শেষ, প্রাক্তন হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন জো ফ্রেজিয়ার লিভার ক্যানসার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ৭ নভেম্বর প্রয়াণ। কিন্তু সেই ক’দিন ওঁর কেবিনের পর্দা ফাঁক করলে, দেখতে পেতাম, জো লড়ছে। মৃত্যুর সঙ্গে নয়, আলি’র সঙ্গে। মহম্মদ আলি। যে আলিকে প্রথম লড়াইয়ে হারানোর পরও, পরের দিনের হেডলাইন আলিকে নিয়েই হয়েছিল। যে আলি শুধুই বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে না লড়লে তো জো-কে কেউ চিনতই না।’ যে আলি, জো-কে সর্বসমক্ষে ‘গরিলা’ বলে অপমান করেছিলেন। যে আলি’র জন্যে, জো-র ছেলেমেয়েরা রোজ স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরত। সেই আলি’র বিরুদ্ধে শেষ এক দান হবে না? আর তখনই কেউ হয়তো বলে উঠেছিল - ইট্স অল ওভার সান।
ঠিক যেমন জো-র ট্রেনার এডি ফাচ বলেছিলেন, ১৪তম রাউন্ডের শেষে, ম্যানিলায়। বা আলি’র ভাষায় বলা ভাল, ‘দ্য থ্রিলা ইন ম্যানিলা।’ ১৯৭৫-এর এই আলি-ফ্রেজিয়ার মহারণ দর্শকের চোখে অবশ্যই থ্রিলার ছিল, কিন্তু মহম্মদ আলি’র এই বাড়তি থ্রিল-এর কারণ কী? হেভিওয়েট টাইটেল তাঁর হাতের মুঠোয়। ফ্রেজিয়ারের বিরুদ্ধে প্রথম হারের বদলাও ১৯৭৪-এ সারা হয়ে গিয়েছে। তা হলে? |
উত্তর আছে বর্ণবৈষম্যে। এবং তার সঙ্গে লেগে থাকা রাজনীতিতে। এমন এক রাজনীতি, যা খেলার ইতিহাসে খুব একটা পাওয়া যাবে না। এক কৃষ্ণাঙ্গ আর এক কৃষ্ণাঙ্গকে দাঁড় করিয়ে হেয় করছে, এবং কী তুলে? না তার গায়ের রং। লড়াইয়ের আগে প্রেস কনফারেন্স-এ আলি ছড়া কাটলেন --- It will be a killer /And a chilla / And a thrilla / When I get the gorilla / In Manila.আরও বললেন, ‘জো ফ্রেজিয়ার-এর মুখটা ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-এ দিয়ে দেওয়া উচিত, ভাল মানাবে... ও এত খারাপ দেখতে যে অন্ধ মানুষও ওকে সামনে পেলে পালিয়ে যায়...ছ্যা ছ্যা ম্যানিলায় লোকে ওকে দেখে ভাববে, কালো’রা এতটা অজ্ঞ, কুৎসিত, মূর্খ হয়?’ আর ১৯৭১-এর প্রথম লড়াইয়ের মতো আলি জো-কে আবার বললেন ‘আঙ্কল টম।’
অজ্ঞ, কুৎসিত, মুর্খ, গরিলা বেশ অপমানজনক, নিঃসন্দেহে, কিন্তু বর্ণবৈষম্যের হাওয়ায় পড়ে ‘আঙ্কল টম’ তকমাটা মাথা খারাপ করে দিল ফ্রেজিয়ার-এর। হ্যারিয়েট স্টো’র ‘আঙ্কল টম’ ছিলেন এক শান্তিপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ বৃদ্ধ, যিনি যিশু’র মতো হাসি মুখে দেহে পেরেক খেতে রাজি ছিলেন, কারণ হিংসা দিয়ে তো কোনও ভালই হয় না। কিন্তু সে তো ১২০ বছর আগেকার কথা, ১৯৭১-এ ‘আঙ্কল টম’-এর মানে বিস্তর পাল্টে গিয়েছে। সে এখন শ্বেতাঙ্গের হাতে অতি সহজেই বশ্য। এবং কোনও আক্ষেপ ছাড়াই। ফ্রেজিয়ার নাকি তাই। কর্তৃপক্ষের লোক? বিশ্বাসঘাতক? আর মহম্মদ আলি, প্রতিষ্ঠানবিরোধী ‘পিপল্স চ্যাম্পিয়ন।’
১৯৬৭ সালে কেসিয়স ক্লে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহম্মদ আলি হলেন আর তার পরই বুক চিতিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘I ain’t got no quarrel with Vietcong.’ মানে আমি ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে যাব না। ভেতর ভেতর ছটফট করলেও কোনও কৃষ্ণাঙ্গ নেতা এ ভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলেননি কখনও। আলি বললেন, ‘কাদের জন্যে লড়ব? যারা আমার ভাইদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে যায় অবিরাম? গণতন্ত্র’র গ নেই এখানে, আর আমি যাব ভিয়েতনামে গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়াতে? জেল-এ পুরুক, পরোয়া করি না, ৪০০ বছর ধরে জেলেই তো রয়েছি।’
একটা গোটা কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ তেতে উঠল। অহিংস সিভিল রাইট মুভমেন্ট-এর পাশাপাশি মাথা চাড়া দিল ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্ট। তাঁরা আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়, বরং মুঠো শক্ত করে পাওনা ছিনিয়ে নিতে উদ্যত। ব্ল্যাক পাওয়ার যেন হয়ে উঠল ‘রিভার্স কু ক্লাক্স ক্ল্যান।’ আর মহম্মদ আলি, সেই আন্দোলনের ‘পোস্টার বয়।’ নিষেধাজ্ঞা জারি হল তাঁর নামে। কেড়ে নেওয়া হল তাঁর হেভিওয়েট টাইটেল। লড়াই করে নতুন চ্যাম্পিয়ন হলেন ফ্রেজিয়ার। আর তার পর যখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, আলি ফ্রেজিয়ারকে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, ‘জো শত্রুপক্ষের লোক, আঙ্কল টম। ও তো white man’s hope...’
ট্র্যাজেডি এখানেই। যে ফ্রেজিয়ার-এর ছোটবেলা সর্বদা শ্বেতাঙ্গদের চাবুক এড়িয়ে চলেছে, যাঁকে রাস্তাঘাটে জল খেতে হলে ‘কালো’দের আলাদা জলের লাইনে দাঁড়াতে হত, যে ফ্রেজিয়ার আলি’র বক্সিং থেকে নির্বাসন মেনে নেননি এবং প্রতিবাদে পরবর্তী হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ প্রতিযোগিতা বয়কট করেন, সেই ফ্রেজিয়ারই নাকি white man’s hope!
আরও বড় ট্র্যাজেডি অপেক্ষমাণ। আলি যখন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার দিকে তাক করে একের পর এক বোমা ফাটাচ্ছেন, তখন বেসামাল শ্বেতাঙ্গ বক্সিং সমাজ এই ফ্রেজিয়ারকেই তাঁদের জবাব হিসেবে খাড়া করল। কী আর করবে, আলিকে রোখার মতো অন্য কেউই তো নেই দিগন্তে। অতএব বৃত্তের মধ্যে ঢুকিয়ে নাও তাকে। অনুগত এবং সত্যিকারের দেশভক্ত হিসেবে চিহ্নিত করো তাকে। ‘সিম্বল’ করে তোলও তাকে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আলি-র অন্য মেরু।
ছোট থেকে যে শুধুই বঞ্চনা দেখেছে, তাঁর কাছে এই সম্মানের কী মানে, বলে দিতে হয় না। মুশকিল হল, জো ফ্রেজিয়ার প্রাপ্য সম্মানটুকুই চেয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতীক হতে নয়। চেয়েছিলেন বিশ্বসেরা বক্সার হবেন, আর কিচ্ছু না। কিন্তু খেলা তো তখন হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘দয়া করে আলি-র বক্সিং লাইসেন্স ফিরিয়ে দিন, বলছে ওকে না হারালে নাকি আমি হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নই নই। আমি ওকে হারাতে চাই, আপনার জন্যে।’ এই শেষ ‘আপনার জন্যে’ উচ্চারণ করেই জো অজান্তেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। ১৯৭১-এর প্রথম আলি-ফ্রেজিয়ার লড়াইয়ের সময়, শ্বেতাঙ্গ সমাজ ফ্রেজিয়ার-এর হয়ে গলা ফাটাল, আর হেরে গিয়ে আলি বলতে পারলেন, ফ্রেজিয়ার white man’s hope, আঙ্কল টম! জিতেও ফ্রেজিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের কাছে ভিলেন। আর শ্বেতাঙ্গদের কাছে তো আলি আগেই তাঁকে মূর্খ, জানোয়ার বলে হাসির খোরাক করে রেখেছিলেন।
মৃত্যু পর্যন্ত জো এই সব কলঙ্ক মুছতে পারেননি। স্রেফ রাজনীতি বোঝেননি বলে। খেলাকে শুধু খেলাই ভেবেছিলেন বলে। তাই তো যখন রাজনীতি দিক বদলে ১৯৯৬-এর আটলান্টা অলিম্পিক্স-এ মহম্মদ আলিকে মশাল জ্বালানোর সম্মান দিল, ফ্রেজিয়ার অন্ধকার ঘরে বসে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে করছে ওকে ওই আগুনে ঠেলে দিই।’
সারা জীবন আয়নায় অন্যের তৈরি করে দেওয়া ইমেজ দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক নয় কি? |