|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
উদ্বাস্তুরা হঠাৎই অনুপ্রবেশকারী হয়ে গেলেন |
উদ্বাস্তু আইন সংশোধন হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে সমস্যা বেড়েছে মাত্র, সমাধানের দিশা মেলেনি।
বিপন্ন দু’কোটি মানুষ। কোন অপরাধে? প্রশ্ন তুলেছেন
অসীম চট্টোপাধ্যায় |
ইতিহাসের ফেলে-আসা সমস্যা ক্রমাগত অবহেলায় সম্যক সমাধানের অভাবে ক্রমেই জটিলতর হয়ে কী ভাবে বিপুল জনসমুদয়কে চরম বিপাকে ফেলে দিতে পারে, উদ্বাস্তু সমস্যা তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এর অনিবার্য ফল হিসাবে ভারতে প্রায় দু’কোটি মানুষ এখন রাষ্ট্রবিহীন হয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার বিড়ম্বনার সম্মুখীন। অথচ বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলির এই নিয়ে কোনও হেলদোল নেই, এমনকী মানবাধিকার নিয়ে সতত সরব আমাদের সুশীল সমাজও মৌনী। |
|
ভিনদেশি? উদ্বাস্তুর ঢল। ফাইল চিত্র। |
দেশভাগের ফলে স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে পুরো পঞ্চাশের দশক জুড়ে যে বিপুল উদ্বাস্তু স্রোত এ দেশে এসেছে, তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এখন কার্যত স্তব্ধ। জনগণনার পরিসংখ্যানেই তা বোঝা যায়। ফলে, উদ্বাস্তু সমস্যা আর রাজনৈতিক দল বা সুশীল সমাজের এজেন্ডায় নেই। কিন্তু ঘটনা হল, উদ্বাস্তু স্রোত বন্ধ হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। যে উদ্বাস্তুরা এসেছেন, তাঁদের নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করার দায়বদ্ধতা রয়েই যায়। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানে গড়িমসি সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, জটিল করেছে। আসলে নাগরিকত্ব আইনে অস্পষ্টতা এবং পরবর্তী কালে ১৯৮৬ সালে ও বিশেষত ২০০৩ সালে অবিবেচনাপ্রসূত সংশোধনী উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব অর্জনের রাস্তা বন্ধ করে এ দেশে বসবাসকারী প্রায় দু’কোটি মানুষকে রাষ্ট্রবিহীন বিপন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।
|
পূর্বকথা |
আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৫ নম্বর থেকে ১১ নম্বর, অর্থাৎ মোট সাতটি ধারায় নাগরিকত্বের প্রশ্নে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ৫ ও ৬ ধারার তিনটে করে উপধারা আছে।
৫(এ) ধারায় বলা হয়েছে, যাঁরা ভারতীয় ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করবেন, তাঁরা জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন। ৬(বি) ধারায় বলা হয়েছে, পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত মানুষকে ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন থেকে ভারতের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হবে, যদি তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই বা তার আগে ভারতে চলে এসে থাকেন। স্পষ্টত, রাষ্ট্রনায়করা বুঝেছিলেন যে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা সমার্থক, এবং যেহেতু এই সমস্যা সমাধানে সার্বিক জনবিনিময় বাস্তবসম্মত নয়, ঈপ্সিতও নয়, তাই উভয় দেশের সরকারই নিজ নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের স্থানান্তরণের ইচ্ছাকে মর্যাদা দানের কথা ঘোষণা করে উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব নিতে অঙ্গীকার করে।
কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। এর পর বারে বারে উদ্বাস্তু-স্রোত এ দেশে আছড়ে পড়ে ১৯৪৮ সালের সময়সীমাকে অপ্রাসঙ্গিক করেছে এবং নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন অনিবার্য হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পরেও সমস্যার কোনও ইতরবিশেষ হয়নি। ফলে ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৭, ১৯৬০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯২ এবং ২০০৩ সালে অর্থাৎ মোট সাত বার সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু, সমস্যা সমাধানের বদলে জনমানসে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে এই অতিকথা যে, বার বার কাতারে কাতারে বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য দরজা খোলা রাখা শুধু অর্থহীনই নয়, এ দেশের অর্থনীতির জন্য এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতে, জনবিন্যাসের ভারসাম্যর পক্ষে বিপজ্জনক। বিজেপি প্রত্যাশিত ভাবেই এই প্রশ্নে শুধু মুসলিম অনুপ্রবেশের বিপদ দেখছে। অথচ ঘটনা হল, এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা মুসলিম জনসাধারণ নন। তাঁরা হিন্দু, এবং আরও নির্দিষ্ট ভাবে, দরিদ্র, অশিক্ষিত, দলিত হিন্দু। এঁদের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি!
উদ্বাস্তু-স্রোত নিয়ে এ সব কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশভাগের সেই বেদনাদায়ক ইতিহাস ভুলে গিয়েছেন, বিস্মৃত হয়েছেন দু’টি কঠিন সত্য।
এক, বিপুল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একযোগে দেশত্যাগ করলে উভয় দেশেই বিপর্যয় অনিবার্য হবে ভেবে উভয় দেশের নেতারাই দেশান্তরণের গতি শ্লথ ও বিলম্বিত করতে চেয়েছিলেন। এই জন্যই সংখ্যালঘুদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য ভারতের সংবিধানে যেমন ২৬, ২৯ ও ৩০ নং ধারায় বিশেষ অধিকার স্বীকৃত রয়েছে, তেমনই পাকিস্তানের সংবিধানেও ২০৫, ২০৬ ও ২০৭ ধারায় সংখ্যালঘু ও তফসিলিদের জন্য বিশেষ সুবিধা ঘোষিত হয়েছে। অনেকেরই জানা নেই যে, পাকিস্তান সরকার এ জন্য ২০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত রাখে, যার ১০ শতাংশ তফসিলিদের জন্য, ৯ শতাংশ উচ্চবর্ণ হিন্দুদের জন্য ও ১ শতাংশ বৌদ্ধদের জন্য সংরক্ষিত হয়। এ সবেরই লক্ষ্য ছিল নাগরিকদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা, যাতে তাঁরা দেশত্যাগ না করেন। এই জন্যই ১৯৫০ সালে ৮ এপ্রিল নেহরু-লিয়াকত আলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নেহরু তাঁর দু’জন মন্ত্রী চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও অনিল চন্দকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠান সে দেশের সংখ্যালঘুদের বুঝিয়ে দেশত্যাগে নিরস্ত করতে। তখনই ভারত সরকার অঙ্গীকার করে, প্রয়োজনে বিলম্বে দেশত্যাগ করলেও সরকার সহযোগিতা করবে। ভারত সরকারের এই আশ্বাসের ওপর ভরসা করেই বহু মানুষ ও-দেশে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর একটা শ্রেণি-দৃষ্টিকোণও ছিল। সমৃদ্ধ, শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের পক্ষে দেশত্যাগ করা যত সহজ ছিল, দরিদ্র, অশিক্ষিত, দলিত হিন্দুদের পক্ষে সাত তাড়াতাড়ি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই, এখন কেন বারংবার উদ্বাস্তুরা আসেন, সে কথা বলে লাভ নেই। বরং মনে রাখা দরকার যে এটি দেশভাগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়।
দুই, স্বাধীনতার সেই সন্ধিলগ্নে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, ‘আমরা সেই সব ভাইবোনদের কথা ভাবছি, যাদের একটি রাজনৈতিক সীমারেখার দ্বারা আমাদের থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে,...তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা আমাদেরই এক জন এবং ভবিষ্যতে আমাদের এক জন থাকবেন।’ গাঁধীজি বলেন, ‘যে সমস্ত শিখ ও হিন্দুরা পাকিস্তানে আছেন, তাঁরা যদি সেখানে না থাকতে চান, তা হলে যে কোনও সময়ে, যে কোনও ভাবে ভারতে চলে আসতে পারেন।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষেরা আমাদের রক্তমাংসের সমান, যাঁরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। একটা সীমারেখার ও পারে পড়েছেন বলে হঠাৎই তাঁরা বিদেশি বলে গণ্য হতে পারেন না।’
|
অতঃপর |
এই ইতিহাস ও প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিচার করলেই এই সংশোধনীতে নিহিত বিশ্বাসঘাতকতা উন্মোচিত হয়ে যায়। কী আছে ২০০৩ সালের সংশোধনীতে? ২০০৩ সালের আইনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি আবারও সংশোধন করা হয়েছে। এ বার বলা হয়েছে, ‘মা এবং বাবা দু’জনেই ভারতের বৈধ নাগরিক না হলে, কোনও শিশু ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও সে জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে না।’ অন্য একটি ব্যবস্থা অবশ্য এই ধারায় বলা হয়েছে। সেটি হল, ‘মা-বাবা দু’জনেই ভারতীয় নাগরিক না হলেও চলবে। সে ক্ষেত্রে এক জনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে, তবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না। তাকে বৈধ উপায়ে ভারতে আসতে হবে।’
এই আইনে ২(১) বি নং সাংঘাতিক ধারা যুক্ত রয়েছে, যা দিয়ে উদ্বাস্তুদের পুরুষানুক্রমে যুগ যুগ ধরে নাগরিকত্ব হরণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই ২(১)বি ধারায় অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে যে ‘যে কোনও বিদেশি, যে বা যারা পাসপোর্ট বা অনুরূপ কোনও বৈধ অনুমতি পত্র ছাড়া ভারতে এসেছেন/ঢুকেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অনুপ্রবেশকারী।’ ভিসা-র মেয়াদ ফুরোনোর পর থেকে গেলেও অনুপ্রবেশকারী।
দু’টি কারণে এই ধারা সাংঘাতিক। এক, জন্মসূত্র ছাড়াও দরখাস্ত করে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার পথটি এই ধারার ফলে খারিজ হয়ে গিয়েছে। দুই, অনুপ্রবেশকারী শনাক্তকরণের কোনও সময়সীমা বা কাট অব ডেট না থাকায় চল্লিশ/পঞ্চাশ বছর আগে এসে এখানে বসবাসরত উদ্বাস্তুদের এই ধারা বেনাগরিক ঘোষণা করে দিয়েছে।
যে অবস্থায় পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তুরা চলে আসতে বাধ্য হন, সেখানে বৈধ অনুমতিপত্রের কথা বলা বাতুলতা। লক্ষণীয় যে, সেই সময় কিন্তু চলে আসার কোনও সময়সীমার কথা বলা হয়নি। এত বছর পর বৈধ কাগজপত্রের কথা তুলে আসলে এই সব মানুষকেই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আতঙ্কের বিষয় হল, এখন ‘ডাইনি সন্ধান’ করে তাঁদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এঁদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। ফলে দেশবিহীন এক বিপন্ন সম্প্রদায় সৃষ্ট হয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় ২ কোটি।
আরও লক্ষণীয় যে, এঁরা অনুপ্রবেশকারী বলে এঁদের ছেলেমেয়েরা, যাদের জন্ম এ দেশে হয়েছে এবং যারা কোনও দিন পাকিস্তান বা বাংলাদেশ দেখেনি, তারাও অনুপ্রবেশকারী। এই ভাবে বিপুল জনতাকে পুরুষানুক্রমে দেশবিহীন রাখার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। এদের নাম ভোটার তালিকায় উঠবে না, এদের পাসপোর্ট হবে না, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে না, চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সব পথ বন্ধ। এমনকী ব্যক্তিগত আক্রোশে কেউ যদি এরা বাংলাদেশি বলে থানায় অভিযোগ করে, তা হলে এদের জেল-হাজত নিশ্চিত।
এই সব বিচার করে বলা যায় যে, ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন নৈতিক ভাবে অন্যায্য, রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক, সামাজিক ভাবে ক্ষতিকর এবং আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মজার কথা দুটো। এক, এই আইন, যা উদ্বাস্তুদের অধিকার হরণ করছে, তার প্রাথমিক লক্ষ্য হল আমেরিকা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি উন্নত দেশের নাগরিক ভারতীয়দের জন্য নাগরিকত্বের দরজা খুলে দেওয়া। দুই, এন ডি এ আমলে যখন এই আইন প্রণীত হয়, তখন সংসদে তৎকালীন বিরোধী নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং নির্দল সদস্য জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরি উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে এই আইনে মানবিক ধারা সংযোজনের প্রস্তাব রাখেন এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সংসদে সে কথা স্বীকার করেন নেন, অথচ তার কোনও প্রতিফলন আইনে রাখা হয়নি।
ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের নেতারা পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে যেমন দক্ষ, রাজনৈতিক ডিগবাজিতেও তেমনই পটু।
chatterjeeashim@yahoo.com |
|
|
|
|
|