প্রলোভন ছিল বিস্তর। মনোরম আবহাওয়ায় টেস্ট ক্রিকেট দর্শন। সর্বোপরি, ক্রিকেট রূপকথার প্রত্যক্ষদর্শী হইবার হাতছানি। সচিন তেন্ডুলকর যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁহার শততম শতরানটি ইডেন উদ্যানেই করিয়া ফেলেন! তথাচ, লোক হয় নাই। শূন্যপ্রায় ইডেনে ভারতীয় খেলোয়াড়দের পরাক্রম এবং গঙ্গার বিষণ্ণ বাতাস খেয়াল করিয়াছে, মা কী ছিলেন, এবং কী হইয়াছেন! প্রায় এক লক্ষ মানুষের সম্মিলিত গর্জনধ্বনি বোলারের পদছন্দে মিলিয়া যাইত একদা, বা ব্যাটধারীর নৈপুণ্যে চিৎকার করিত লক্ষ জনতা! আজ কার্যত মাছি তাড়াইবার দশা। শুধু ইডেন উদ্যান নহে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই টেস্ট ক্রিকেট জনতার দরবারে ব্রাত্যজনের পর্যায়ে উপনীত। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা ভাবিতেছে, বড় শহর বাদ দিয়া ছোট শহরগুলিতে টেস্ট ক্রিকেটের আসর বসানো যায় কি না!
কিছু দেশের জনতা ক্রিকেট দেখিতে ভালবাসেন। বিশেষত, ভারতে ক্রিকেট কার্যত জাতীয় খেলার মর্যাদা পাইয়া থাকে। ক্রিকেট খেলোয়াড়গণ বীরপূজা উপভোগ করেন। ফলে, ক্রিকেট একটি বৃহৎ বাজার তৈরি করিয়াছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো বটেই, স্থানীয় ক্রিকেটও টেলিভিশনে নিয়মিত সম্প্রচারিত হয়। ‘আই পি এল’ নামক বিচিত্র ক্রিকেট-আসরটি ভারতের একটি বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হইয়াছে। এই পর্যন্ত স্বর্ণাভ, সন্দেহ নাই। ইহার পার্শ্বে টেস্ট ক্রিকেটের জনশূন্য অঙ্গনটি দেখিলেই বুঝা যায়, অসুখটি কোথায়। ক্রমাগত ক্রিকেট-দর্শনে অভ্যস্ত জনতার নিকট ব্যাট-বলের যুদ্ধ আর সেই মায়া নির্মাণ করিতেছে না। ‘টি টোয়েন্টি’ নামক স্বল্পস্থায়ী মজায় তবু লোক টানিবার কিছু মশলা আছে। মাঠে গিয়া টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুপদী এবং বিলম্বিত লয় গ্রহণ করিবার ন্যায় মানুষ ক্রমেই দুর্লভ। চ্যানেল ঘুরাইবার ফাঁকে যদি এক লহমা দেখিয়া লইলেই চলে, তাহা হইলে মাঠে গিয়া কী লাভ! আয়োজকগণ টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রয় করিয়া মোটা অর্থ পাইতেছেন, তাই ফাঁকা গ্যালারি হৃদয়বেদনার সঞ্চার করিতেছে না। সমস্যা হইল, জনতা যদি মুখ ফিরাইয়া লয়, তাহা হইলে পাঁচ দিন ব্যাপী ক্রিকেটের এই আসর কত কাল এই চেহারায় টিকিবে, সে প্রশ্নও উঠিয়া যায়!
সমাধান কি ছোট শহরেই? হয়তো বা। এই ভাবেই হয়তো বাজারের বিভিন্ন স্তরে টেস্ট ক্রিকেট এবং টি টোয়েন্টি সহাবস্থান করিতে পারিবে। ক্রিকেট বিনোদনের একটি বৃহৎ অঙ্গ দৃশ্যের চমক, পরিভাষায় যাহাকে ‘স্পেকট্যাকল’ বলা চলে। ছোট শহরে যে হেতু এই জাতীয় চমকের সম্ভাবনা কম, তাই সেই সব অঞ্চলের বাজার হয়তো টেস্ট ক্রিকেটকে স্বাগত জানাইতে পারে। মহানগরীগুলিতে নিয়মিত রূপেই এই জাতীয় চমকপ্রদ দৃশ্যের জন্ম হয়। তাই বিস্ময়ের অবকাশ কম। সুতরাং, টেস্ট ক্রিকেটের কিছু বিস্ময় ক্ষুদ্রতর শহরগুলিতে থাকিতেই পারে। পাশাপাশি, ছোট শহরে টেস্ট ক্রিকেটের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খেলার আসর বসিলে সেখানে ক্রীড়া পরিষেবা তো বটেই, অনুষঙ্গে পর্যটন বা পরিবহণের ন্যায় অন্য নানাবিধ পরিষেবারও উন্নতি হইবার সম্ভাবনা বিপুল। বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় এক নগরকেন্দ্রিক রাজ্যে এই জাতীয় ভাবনা অন্যতর গুরুত্বের দাবি রাখে। যদি বর্ধমান বা শিলিগুড়িতে টেস্ট ক্রিকেট করিতে হয়, তবে সর্বাগ্রে পরিকাঠমোর উন্নতি করিতে হইবে। একটি আকর্ষণীয় ভাবনার জন্ম হইয়াছে। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কী বলে। |