মলদ্বীপে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা গোষ্ঠীর (সার্ক) সপ্তদশ শীর্ষ সম্মেলন সাঙ্গ হইয়াছে। সার্ক-এর আটটি সদস্যরাষ্ট্রের প্রধানরাই তাহাতে উপস্থিত ছিলেন। বুঝা যায়, এখনও এই দেশগুলির কাছে আঞ্চলিক সহযোগিতার এ ধরনের মঞ্চের উপযোগিতা রহিয়াছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘আসিয়ান’-এর আদলেই সার্ক গঠিত হইয়াছিল। লক্ষ্য ছিল, প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত দেশগুলির মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করিয়া অঞ্চলের উন্নয়নের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। কিন্তু প্রায়শ দ্বিপাক্ষিক মনোমালিন্যের অবসান ঘটাইতেই সার্ক-এর সম্মেলনগুলির সময় কাটিয়া গিয়াছে, বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিশেষ অগ্রগতি হয় নাই। আসিয়ান, বা পরবর্তী কালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সাফল্যের মুখ দেখিয়াছে, সার্ক তাহার ধারে-কাছেও পৌঁছাইতে পারে নাই। সম্প্রতি অবশ্য অঞ্চলের দুই প্রধান দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস সামগ্রিক ভাবে সার্ককেও খানিক গতিশীল করিয়াছে। বিশেষত বাণিজ্য সম্পর্ক সুষ্ঠু করার দিকে সদস্যরা মন দিয়াছে।
কিছু কাল আগে পর্যন্ত অঞ্চলের বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারতের সহিত ভুটান ও মলদ্বীপ ছাড়া অধিকাংশ প্রতিবেশীর সম্পর্কেই অবিশ্বাস ও সন্দেহের কাঁটা বিঁধিয়া থাকিত। ইদানীং বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমার, এমনকী পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্কে কিছু উষ্ণতা লক্ষ করা যাইতেছে। নয়াদিল্লির কর্তারা সম্ভবত বুঝিয়াছেন, ভারত হাত সরাইয়া লইলে দক্ষিণ এশিয়ায় তাহার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চিন হাত বাড়াইয়া দিবে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মায়ানমারের সহিত চিনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রীতিমত দৃঢ়। ভারতের উদ্যোগেই যদিও আফগানিস্তান সার্ক-এর সদস্য হইতে পারিয়াছে, তথাপি ইতিহাস, ভূগোল ও বর্তমান রাজনীতির বাধ্যতায় কালক্রমে পাকিস্তানের সঙ্গেই কাবুলের জোটবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। প্রতিবেশীদের মন জয় করার তাগিদ তাই দিল্লিরই বেশি। তবে ইহা কেবল সার্ক-এর রাজনৈতিক দিক। সার্ক আরও বেশি কার্যকর হইয়া উঠিতে পারে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আর্থিক ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করিয়া। এ জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে পরস্পরের উৎপাদিত পণ্যের আমদানি-রফতানিতে শুল্ক ছাড়ের ক্ষেত্রগুলিকে ক্রমাগত প্রসারিত করা দরকার। একটি উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হইবে। পাকিস্তানের সহিত ভারতের বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেন মাত্রই ২৬৫ কোটি ডলারের, অথচ সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মারফত দুই প্রতিবেশী ১ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য-বিনিময় করিয়া থাকে, সরাসরি পরস্পরকে রফতানি করিলে যাহাতে প্রভূত সময় ও অর্থের সাশ্রয় হইত। ভারতীয় পণ্যের আমদানিতে ইসলামাবাদ নিষেধাজ্ঞা ক্রমে শিথিল করিতেছে। দুই তরফেই যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা রদ করিয়া শুল্ক ছাড়ের সিদ্ধান্ত লইলে দুই দেশই উপকৃত হইবে। এ ভাবেই অন্য প্রতিবেশীরাও আর্থিক সহযোগিতার বনিয়াদ দৃঢ় করিতে পারে।
সহযোগিতা বৃদ্ধির অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও নজর পড়িতেছে। দারিদ্র দূরীকরণ, জ্বালানি, জলসম্পদ সংরক্ষণ, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার মতো বিষয়ে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলির সহযোগিতা অঞ্চলের জনসাধারণের পক্ষে সুফলপ্রসূ হইতে বাধ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরস্পরের কাছ হইতে শিখিবার, সাহায্য লইবার প্রয়োজন আছে। মানব-উন্নয়নের এই প্রাথমিক বর্গগুলিতে উপমহাদেশের পশ্চাৎপদতা রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে উদ্বিগ্ন করে। সত্য, রাজনীতির কাঁটাগুলি পুরোপুরি সরাইয়া না ফেলিলে পারস্পরিক সহযোগিতায় আস্থা ও ভরসা সঞ্চারিত হইবে না। আবার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরস্পরের আস্থা অর্জন করিলে বিরোধের তীব্রতা হ্রাস পায়, তাহাতে নিষ্পত্তির আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। মলদ্বীপ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রটি পড়িলে মনে হয়, উপমহাদেশের প্রতিবেশীরা বিষয়টি কম-বেশি উপলব্ধি করিয়াছেন। |