রাত পৌনে ১টা।
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মাল্টিপ্লেক্সে সবে নাইট শো ভাঙছে। এ বার বাড়ি ফিরবেন শহুরে নাগরিক। কিন্তু, শপিং মল-মাল্টিপ্লেক্স লাগোয়া পুলিশ-কিয়স্কের জানলা দিয়ে উঁকি মারলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখে পড়বে শুধু দু’টো চেয়ার, একটা খালি জলের বোতল আর ভাঁজ করা খবরের কাগজ। এ সব যাঁরা ব্যবহার করতে পারতেন, সেই পুলিশকর্মীদেরই কোনও চিহ্ন নেই। কারণ, ঢের আগেই ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে তাঁরা বেমালুম ঝাঁপ গুটিয়ে চলে গিয়েছেন।
সোমবার রাতের কলকাতায় পুলিশ-কিয়স্কের ‘অতন্দ্র নজরদারি’র এই ছবিটা আলাদা নয় ময়দানের রেড রোডেও। সেখানেও ঝাঁপ বন্ধ কিয়স্কের। আর উত্তর কলকাতার ছবি? সেখানে টালা সেতু থেকে নেমে বি টি রোড ধরে সিঁথির মোড় পেরিয়ে প্রায় কলকাতা পুলিশের সীমানার শেষ পর্যন্ত পুলিশ তো দূরের কথা, কিয়স্কেরই নামগন্ধই নেই।
কিয়স্কের বাইরে শহরের রাজপথেই বা পুলিশ কই?
রাত ২টো।
উত্তর কলকাতায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ বা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে কিছু দূর অন্তর উর্দিধারীদের দেখা গেলেও সংলগ্ন বিবেকানন্দ রোড, আমহার্স্ট স্ট্রিট, অরবিন্দ সরণি বা রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট প্রায় খাঁ খাঁ করছে। মূল শহরের অন্যতম প্রবেশপথ উল্টোডাঙার মোড়ে পুলিশের একটি ভ্যান থাকলেও ‘সন্দেহজনক’ গাড়ির পথ রোধের জন্য গার্ডরেল নেই। ওই মোড় লাগোয়া ‘ভিভিআইপি-জোন’ সল্টলেকে ঢোকার হাডকো মোড়ও কার্যত অরক্ষিত। |
শিয়ালদহ-চত্বর তখনও যথারীতি জমজমাট। কোলে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের আনাগোনা চলছে পুরোদমে। কিন্তু সেখানেও পুলিশি নজরদারি বলতে সবেধন নীলমণি একটি কিয়স্ক ও টহলদার জিপ। মসলন্দপুর থেকে আগত অধীর মণ্ডল বললেন, “রাতে খুচখাচ ঝামেলা লেগেই থাকে। তখন অনেক ক্ষেত্রেই কিয়স্কের পুলিশের সাহায্য মেলে না। ছুটতে হয় সেই থানায়।”
উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলি লাগোয়া কলকাতা পুলিশের এলাকায় জিপ অথবা মোটরসাইকেলে টহলরত পুলিশকর্মীদের কার্যত কোনও দেখাই মেলেনি। শহরের পরিচিত মোড়গুলির মধ্যেও বেশ কয়েকটিতেই দেখা মিলেছে নামমাত্র পুলিশকর্মীর।
কিন্তু কেন এই অবস্থা? |
পুলিশের যুক্তি: লোকাভাব। টহলদারির এই দৈন্যের কারণ হিসেবে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতা পুলিশের ঘাড়ে সংযোজিত এলাকার ‘বোঝা’ এসে পড়াটাকেই তুলে ধরছেন লালবাজারের কর্তারা। পুলিশহীন কিয়স্কগুলির প্রসঙ্গে যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম বলেন, “সংযোজিত এলাকার বাড়তি ১৭টি থানার দায়িত্ব কলকাতা পুলিশকে নিতে হলেও কর্মী-সংখ্যা সে ভাবে বাড়েনি। সব কিয়স্কে তাই রাতে পুলিশ দেওয়া যাচ্ছে না। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন কিয়স্কে নজরদারি চলছে।”
কিন্তু, প্রধানত রাতের কলকাতায় রাজপথে পুলিশের উপস্থিতিকে ‘দৃশ্যমান’ করতেই এত দিন কিয়স্কগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন লালবাজারের কর্তারা। ২০০৬ সালে প্রসূন মুখোপাধ্যায় পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন চালু হওয়া এই কিয়স্কগুলি রাতের কলকাতায় পুলিশি নজরদারির চোখ হয়ে উঠবে, এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাতে সব ক’টি কিয়স্ক চালু রাখতে না পারায় এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যটাই যে ব্যর্থ হচ্ছে, সে কথা মেনে নিচ্ছেন পুলিশকর্তারাও। পুলিশ সূত্রের খবর, কিয়স্কগুলির ক্ষেত্রে কোথায় কখন পুলিশ থাকবে, স্থানীয় থানার পরামর্শ মেনেই তা ঠিক হয়। কিন্তু সোমবার রাতে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা বলছে, কোনও কোনও কিয়স্ক চালু থাকলেও সেখানে নামমাত্র পুলিশকর্মী। পুলিশ সূত্রের খবর, কিয়স্কগুলিতে এক জন এএসআই পদের অফিসার-সহ কনস্টেবল ও গ্রিন পুলিশ রাখার কথা। কর্তারা মানছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নিয়মটা মানা যাচ্ছে না। |
রাত আড়াইটে।
টহলদারির ফাঁকফোকরের বিষয়েও লালবাজারের কর্তাদের কাছ থেকে সদুত্তর মেলেনি। রাত দেড়টায় টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে জমে উঠেছে লরিদের ‘রেস’। যে গার্ডরেল থাকলে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত, সেগুলি বেমালুম উধাও। গোলপার্কের মুখ থেকে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের শেষ পর্যন্ত সাকুল্যে দু’জন মোটরসাইকেল আরোহী পুলিশের দেখা মিলল। অসহায় ভঙ্গিতে তাঁরা একটি বেপরোয়া গাড়িকে থামানোর চেষ্টা করছেন।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “কলকাতা পুলিশের সংযোজিত নতুন এলাকাগুলিতে রাত-পাহারার বিষয়টি ঢেলে সাজা দরকার। সেই সঙ্গে পুরনো বিভিন্ন এলাকার ভিতরের কিছু ফাঁকফোকর নিয়েও স্থানীয় থানাগুলির সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসা হবে।’’
|