প্রথাগত চাষে ঝুঁকি কম নেই। কখনও অতিফলন, কখনও সংরক্ষণ ও বিপণনের অভাব ডেকে আনে সর্বনাশ।
তবু ধান, পাট, আলু চাষ আঁকড়ে আছেন অনেকেই। বিকল্প চাষ কি দেখাতে পারছে মুক্তির পথ? আজ শেষ কিস্তি। |
কালনা মহকুমায় বিকল্প চাষ হিসেবে সূর্যমুখী, বাদাম, ডালশস্য-সহ বেশ কয়েকটি ফসলের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বিপণন ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় চাষিরা কেউ এ সব চাষের ঝুঁকি নিতে চান না। এমনই দাবি কৃষি আধিকারিকদের। চাষিদের অবশ্য অভিযোগ, এ সব চাষের ব্যাপারে কৃষি দফতরের তরফে তাঁদের সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনাও করা হয় না।
বস্তুত, চাষবাসের ব্যাপারে চাষিদের সাহায্য করার কথা যাদের, সেই কৃষি দফতরেরই পরিকাঠামো রীতিমতো বেহাল কালনা মহকুমায়। নিয়ম অনুযায়ী, ব্লকগুলির প্রধান পঞ্চায়েতে এক থেকে দু’জন কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক থাকবে, যাঁদের কাজ চাষাবাদের অগ্রগতি নিয়ে চাষিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা। বর্তমানে কালনা-২ ব্লকে এই পদে এক জনও কর্মী নেই। বাকি ব্লকগুলিতে এই পদে রয়েছেন মোট ২-৩ জন করে কর্মী। এর মধ্যে দু’টি ব্লকে দু’জন কৃষিপ্রযুক্তি সহায়ককে খামারের কাজও করতে হয়। চাষাবাদের কাজে যুক্ত অনেকের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়, ‘কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক’ কী, তা অধিকাংশ চাষিই বোঝেন না। শুধু কৃষি প্রযুক্তি সহায়কই নয়, কৃষি দফতরের অন্য বেশ কিছু পদেও কর্মী রয়েছে হাতে-গোনা। চাষাবাদে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, লাভজনক চাষ-সহ নানা ব্যাপারে আগে বিভিন্ন এলাকার চাষিদের নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করা হত। চাষিরা সে সব থেকে পরামর্শ পেতেন। তবে সরকারি উদ্যোগে এখন এই সমস্ত সভা প্রায় হয় না বললেই চলে।
পরিকাঠামোর এমন সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে বিপণন ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ। মহকুমা কৃষি আধিকারিক স্বপনকুমার মারিকের কথায়, “বিকল্প চাষে উৎপন্ন ফসলের বিপণন ব্যবস্থা মহকুমায় অত্যন্ত দুর্বল। সে জন্যও ঝুঁকির রাস্তায় কেউই হাঁটতে চান না কেউ।” মহকুমায় অধিকাংশ মানুষ চাষাবাদের উপরে নির্ভরশীল হলেও পাঁচ মহকুমা ব্লকে কৃষিভিত্তিক শিল্প তেমন গড়ে ওঠেনি। কৃষিভিত্তিক শিল্প বলতে এই মহকুমায় গড়ে উঠছে কিছু ছোট-বড় চাল তৈরির কারখানা। প্রয়োজনের তুলনায় যা যথেষ্ট কম। পাট, আলু, পেঁয়াজের মতো ফসলকে ঘিরে মহকুমায় কোনও শিল্প নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ী সুশীল মিশ্র বলেন, “কৃষিভিত্তিক শিল্প বলতে মহকুমায় ধান থেকে চাল তৈরির কয়েকটি কারখানা রয়েছে। অথচ এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রশাসনকে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।”
কৃষিভিত্তিক শিল্পের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছে মহকুমা প্রশাসনও। মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি বলেন, “উৎপাদনের নিরিখে মহকুমায় কৃষি ভিত্তিক শিল্প সত্যিই বেশ কম। তবে সম্প্রতি পাট ও তাঁতকে একত্রিত করে একটি শিল্পের পরিকল্পনা নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে।” মহকুমায় কৃষির অনিশ্চয়তা দূর করতে মহকুমাশাসকের পরামর্শ, “কৃষি দফতর, কৃষি বিপণন দফতর এবং উদ্যানপালন দফতরের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।”
কালনা মহকুমায় কৃষিভিত্তিক শিল্প-সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেছেন মহকুমা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড স্মল ইন্ডাস্ট্রিজের-র সম্পাদক সুবোধ নস্কর। তাঁর দাবি, এ ব্যাপারে উৎসাহীর অভাব নেই। কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং নাবার্ড-এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভাবে এগিয়ে এলেও পরিস্থিতি পাল্টাবে। মাটির গুণাগুণ অনুযায়ী বিকল্প চাষে চাষিদের উৎসাহিত করার ব্যাপারেও কৃষি দফতরকে উদ্যোগী হতে হবে বলে ওই সংগঠনের সদস্যদের দাবি।
চাষাবাদে লাভের এই অনিশ্চয়তা দূর করার উপায় প্রসঙ্গে মহকুমা কৃষি আধিকারিক স্বপনবাবুর বক্তব্য, “ধান, আলুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফসলের চাষ বন্ধ করা যেতে পারে না। কিন্তু বিকল্প চাষের প্রসার ঘটাতে এই সব ফসলের এলাকা কমানো যেতে পারে।” পাশাপাশি, তাঁর মতে, “প্রথাগত চাষগুলির জন্য লাভজনক একটি নিশ্চিত দর প্রয়োজন। এই নিশ্চয়তা থাকলেই সঙ্কট দূর হবে। চাষের আগে অন্তত চাষিরা আতঙ্কে ভুগবেন না।”
উপায় বা পরামর্শ রয়েছে সকলের কাছেই। কিন্তু তাতে চাষিদের অনিশ্চয়তা কতটা কাটবে, জানা নেই কারও। |