ছিল থ্যালাসেমিয়া। তা থেকে বাঁচতে রক্ত নিতে গিয়ে শিশুর শরীরে ঢুকল মারণ-জীবাণু এইচআইভি। একটি-দু’টি নয়, এ রকম একাধিক ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়!
শিশু দিবসের পর দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত চার শিশুর শরীরে অস্ত্রোপচার হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। আর অস্ত্রোপচার-পর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়েই চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, চার জনের মধ্যে তিন জনের রক্তেই রয়েছে এইচআইভি। এমন কারও অস্ত্রোপচার ঝুঁকির জেনেও তাদের ফেরাননি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তথা পেডিয়াট্রিক সার্জেন সুকুমার মাইতির নেতৃত্বে সিনিয়র চিকিৎসক কুণাল সান্যাল, মৃত্যুঞ্জয় পাল, সুবীর মজুমদার, সর্বাণী দাস, সঙ্গীতা বিশ্বাস-সহ ১০ জনের চিকিৎসক-দল অস্ত্রোপচার করেন।
কিন্তু অস্ত্রোপচারের সাফল্যের থেকেও অন্য এক বেদনাবোধে আচ্ছন্ন চিকিৎসকেরা। যে চার জনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাদের সবাই সরকারি হাসপাতাল থেকেই নিয়মিত রক্ত নিত। প্রথমে মাসে এক বার রক্ত নিতে হত। পরে ১০-১৫ দিন পর-পর রক্ত দিতে হচ্ছিল। রক্ত নিতে সন্তানদের সরকারি হাসপাতালেই নিয়ে আসতেন তাদের বাবা-মায়েরা। তিন শিশু রক্ত নিত মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই। অন্য জন ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালে। আগেও অবশ্য ঘাটাল মহকুমা হাসপাতাল থেকে রক্ত নেওয়া কয়েক জন শিশুর রক্তে এইচআইভি-র জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল।
সরকারি হাসপাতাল থেকে রক্ত নিয়েও কেন এমন অঘটন? পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্রের বক্তব্য, “এইচআইভি-র সদ্য বাহক হয়েছেন (‘উইনডো পিরিয়ড’), এমন কারও রক্তে জীবাণুর অস্তিত্ব প্রাথমিক ভাবে ধরা নাও পড়তে পারে। কিন্তু সেই রক্ত অন্য কারও শরীরে প্রবেশের পরে রক্ত-গ্রাহক আক্রান্ত হয়ে পড়ে।” একই বক্তব্য মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুকুমারবাবুরও। তিনি বলেন, “এই সমস্যা দূর করার কোনও আধুনিক পদ্ধতি এখনও আসেনি বলেই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অবশ্য জানিয়েছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কার্ড চালুর প্রস্তাব রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানোর ভাবনা-চিন্তা চলছে। সেই কার্ড দেখিয়ে রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করলে জানা যাবে রোগী কোন হাসপাতাল থেকে রক্ত নিচ্ছে। অনেকেই আবার বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকেও রক্ত নেয়। তখন সেটাও জানা যাবে। হাতের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য থাকলে সেই হাসপাতালে রক্ত দেওয়ার সময় আরও কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে।
মেদিনীপুর থ্যালাসেমিয়া সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের ২৫ জুন থেকে চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলায় ৪১৩৫ জনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছিল। তার মধ্যে ১৩৩ জন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। সংস্থার কর্মী বাবলু চক্রবর্তীর কথায়, “আমরা প্রতি বছর যা পরীক্ষা করি তাতে দেখা গিয়েছে, ৪ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত।” তিনি বলেন, “সমস্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীই কোনও না কোনও হাসপাতাল থেকে রক্ত নেন। কিন্তু সেই রক্তেই যদি মারণ-জীবাণু থাকে, তা হলে সমস্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীই তো এড্সে আক্রান্ত হবেন। একটা রোগ থেকে বাঁচতে আরও একটা রোগ তৈরি হবে। এ তো মারাত্মক অবস্থা।”
কিন্তু তিন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর অস্ত্রোপচার তাদের রক্তে এইচআইভির উপস্থিতির কারণে বিপজ্জনক জেনেও কেন করা হল? সুকুমারবাবু জানান, অস্ত্রোপাচার না হলে আরও মারাত্মক পরিণতি হবে জেনেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এই অস্ত্রোপচারের পারিভাষিক নাম ‘স্পিলেকটমি’। প্লীহা বড় হওয়ার ফলে ভিতরে তৈরি হওয়া রক্তের কণাগুলি ভেঙে যায়। এমনকী বাইরে থেকে যে রক্ত শরীরে দেওয়া হয় তার কণাও ভেঙে যায়। প্লীহা যত বাড়বে ততই দ্রুত রক্তের প্রয়োজন হয় রোগীর দেহে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা দেখেন, কারও প্লীহা বাদ দিলে কোনও ক্ষতি হবে কি না। যদি দেখেন সমস্যা নেই, তা হলে বাদ দিয়ে দেন। এর ফলে রক্ত দেওয়ার ব্যবধান-কাল বাড়ে। যার ক্ষেত্রে ১৫ দিন ছাড়া রক্ত দিতে হত, তার ক্ষেত্রে হয়তো ৪-৬ মাস পর রক্ত দিলেও চলবে। সাময়িক কষ্ট কমে। জরুরি বলেই ঝুঁকি নিয়েই এই অস্ত্রোপচার করেছেন মেদিনীপুর মেডিক্যালের ডাক্তারবাবুরা।
এক থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর বাবা-মায়ের কথায়, “রক্ত দেওয়ার পর হয়তো দশ দিন ভাল থাকল। তার পরেই খাবারে অনীহা দেখা দেবে। জ্বর আসবে। আর সব কিছুতেই বিরক্তি। তখনই বুঝতে পারি রক্ত লাগবে। আপারেশনের পর চিকিৎসকেরা বলছেন, এ বার আর এত ঘনঘন রক্ত দিতে হবে না। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি।” |