স্কুল ছেড়ে ছিলেন ৫৯ বছর আগে। তারপরে কর্মসূত্রে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, ছেলেবেলার স্কুলটির সঙ্গে চাঁর নাড়ির টান। আর সেই স্কুলে এসে যখন শুনলেন, পাঠাগারের ঘর নেই- তখন চুপ করে থাকতে পারেননি। স্বেচ্ছায় পাঠাগার তৈরির করার দায়িত্ব তুলে নেন।
|
অমিয়ভূষণ রায়। |
তিনি ওন্দার ব্লকের মাদারবনি গ্রামের সন্তান অমিয়ভূষণ রায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রাক্তন প্রধান (ডিন)। এখন শিবতোষ মুখোপাধ্যায় সায়েন্স সেন্টারের ডিরেক্টর পদে রয়েছেন। তিনি তালড্যাংরা ব্লকের হাড়মাসড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। তাঁরই দানেই স্কুলে একটি পাঠাগার গড়ে উঠল। শনিবার এক অনুষ্ঠানের মধ্যে গিয়ে ওই পাঠাগার ভবনের উদ্বোধন করেন বাঁকুড়ার জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক তপনকুমার বর্মন। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান রিঙ্কু বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বহু বিশিষ্টজন।
হাড়মাসড়া উচ্চবিদ্যালয়ে নব নির্মিত পাঠাগার ভবনের জন্য প্রাক্তন ছাত্র অমিয়ভূষণবাবু চার লক্ষ ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তাঁর প্রয়াত মায়ের নামেই তৈরি করা হয়েছে নবীন রায় স্মৃতি পাঠাগার ভবন। তাঁর এই মহৎ দানে খুশি বিদ্যালয়ের পড়ুয়া থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাসিন্দা -সকলেই। বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির সম্পাদক শিবানন্দ চক্রবর্তী বলেন, “দক্ষিণ বাঁকুড়ার অন্যতম প্রাচীন এই স্কুলটি ১৯২১ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এখন এক হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। অথচ গ্রন্থাগারের জন্য ঘর ছিল না। তা জানতে পেরে অমিয়বাবু ২০১০ সালে এই বিদ্যালয়ে এসে পাঠাগার ভবন তৈরি করার টাকা দেন। ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর হল।” বিদ্যালয়ের প্রধআন শিক্ষক রাজগোপাল মহান্তী বলেন, “বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধার কথা ভেবে তিনি পাঠাগার ভবন তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালে কম হবে।” তাঁর এই উদ্যোগে খুশি স্কুলের পড়ুয়ারাও। একাদশ শ্রেণির অমিত মাঝি, অপূর্ব মাঝিদের কথায়, “পাঠাগার ভবন না থাকার জন্য আমাদের খুব অসুবিধা হত। আলাদা কোন ঘর ছিল না পড়ার জন্য। এ বার আমরা পাঠাগার ভবনের ভিতরে বই পড়তে পারব।” তাঁরাও স্কুলের এই প্রাক্তন ছাত্রের প্রতি কৃতজ্ঞ। |
অমিয়বাবুর এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। তাঁদের মধ্যে স্বরূপানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর পাণ্ডা বলেন, “অমিয়বাবু যা করেছেন তাতে আমরাও বিদ্যালয়ের জন্য কিছু কাজ করায় অনুপ্রাণিত হয়েছি। ইতিমধ্যে আমরা স্কুলের শিক্ষকেরা পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে প্রায় দু লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছি। সেই টাকায় শ্রেণি কক্ষ-সহ ৪০টি ঘর রঙ করা হয়েছে।” স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, বেণুবীণা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ এলাকার বহু শিক্ষানুরাগী এই মহতী কাজের প্রশংসা করেছেন। জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক তপনকুমার বর্মন রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, “শিক্ষার প্রসারে অমিয়বাবুর মতোন বড় মনের মানুষের বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা অনেক সহজে বড় সমস্যার সমাধান করে দেন।” জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান রিঙ্কু বন্দো্যপাধ্যায় বলেন, “এই উদ্যোগের ফলে অমিয়বাবুর সঙ্গে তাঁর স্কুলের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়ে উঠল। তাঁর এই ভূমিকা অনুকরণ যোগ্য।”
তবে অমিয়বাবু নিজে অবশ্য এ ভাবে ভাবতে নারাজ। তিনি জানান, ১৯৫২ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ থেকে আইএসসি, আশুতোষ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণি পান। কর্মজীবন শুরু করেন গোবরডাঙা হিন্দু কলেজে। বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ১০ বছর শিক্ষকতা করেন। ২০০২ সালে এবসর গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “এটা আমার স্বপ্নের স্কুল। ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবেই পাঠাগার ভবন তৈরি করতে টাকা গিয়েছিলেন। এই স্কুলের সব রকমের উন্নতির জন্য আমি প্রস্তুত।” সত্তোরর্ধ্ব অমিয়বাবু আরও বলেন, “আমি এই স্কুলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। তাই এই স্কুলের সঙ্গে আমার নাড়ির টান অনুভব করি। স্কুলে এলে বাড়ি ফেরার আনন্দ পাই। ”
|