মেয়ের ইচ্ছেকে ছোট করে দেখবেন না
একটি সমস্যায় পড়ে আপনাদের পত্রিকায় এই চিঠি দেওয়া। পরের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। বয়স ষোলো। ইতিমধ্যেই মা এবং মাসি আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আমাকে না জানিয়ে একটি ছেলের সঙ্গে তাঁরা সব কিছু ঠিকঠাকও করে রেখেছেন। বর্তমানে জোর-জবরদস্তি শুরু করেছেন। পরিবারে আমরা তিন জন বাবা, মা ও আমি। অশান্তির ভয়ে বাবাও মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করতে চাই না। এ কথা বলাতে ঝাঁটা, জুতোর মার সবই আমার কপালে জুটেছে। বর্তমানে মানসিক অত্যাচার (খেতে না দেওয়া, ভাতে জল ঢেলে দেওয়া, খোঁচা দিয়ে কথা বা কথা না বলা) শুরু করেছেন। ঘর থেকে বার করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। রেজাল্ট বেরলেই বলেছেন আমার বিয়ে দেবেন। ছেলেটিকে আমার পছন্দ নয়। তা ছাড়া জীবনটা সম্পূর্ণ আমার, বিয়ের বয়স হোক এ কথা বলায় প্রচুর মার খেতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা সামনে নেই। কয়েক জন বোঝাতে এসে রীতিমতো অপমানিত হয়ে ফিরে গিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কী করব, বা কোথায় যাব, বা কী করণীয় যদি জানান তা হলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মাকে বলছি
আপনি মা হয়ে মেয়ের সঙ্গে অন্যায় করছেন, তা আপনার মেয়ে স্পষ্টই বুঝেছে। আপনি নিজেও বোধহয় তা বোঝেন, তাই মেয়েকে ভয় দেখিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। আঠারো বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া আইনত অপরাধ। ‘আইন তো কত কিছুই বলে’ - এই বলে যদি সেই নির্দেশ এড়িয়েও যান, তা হলেও এ কথা তো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই যে আপনার কিশোরী কন্যা অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছে, এবং আপনার (এবং আপনার বোনের) সিদ্ধান্তই সেই কষ্টের কারণ। তা সত্ত্বেও আপনার সিদ্ধান্তকে হৃদয়হীনতা বলে ধরে নিচ্ছি না। বরং আপনার যুক্তি বোঝার চেষ্টা করছি। বাবা-মা অনেক সময় সন্তানের আপত্তি সত্ত্বেও তাকে নানা কাজ করতে বাধ্য করেন। যখন বাবা-মা শিশুকে খেলতে না দিয়ে পড়তে বসান, রাস্তার খাবার কিনে দেওয়ার বায়না অগ্রাহ্য করেন, তখন তাঁরা ভাবেন, এতে শিশুর ভাল হবে। আপনিও সম্ভবত ভাবছেন, আমার মেয়ে তো ছোট, ও দুনিয়াদারির কী বোঝে। ভাল সম্বন্ধ হাত থেকে চলে গেলে আবার ভাল ঘর-বরের সুযোগ না-ও আসতে পারে। হয়তো ভাবছেন, বিয়ে দেওয়ার টাকা হাতে থাকতে থাকতে বিয়ে দেওয়া ভাল। মেয়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণের টাকার দাবি বাড়তে পারে। মেয়ে নিজে অপাত্রে প্রেম করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে। সম্ভবত আপনি নিজের কথাও ভাবছেন দায়িত্ব দ্রুত শেষ করে ‘ঝাড়া হাত-পা’ হতে চাইছেন।
এর কোনওটা সাংসারিক দৃষ্টিতে ফেলনা নয়। কিন্তু আপনার হিসেব থেকে আপনার মেয়েটাই বাদ পড়ে যাচ্ছে না তো? ভেবে দেখুন, আপনি কতগুলি সম্ভাবনা আপনার মেয়ের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। এক, মেয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত, স্বাবলম্বী হয়ে একটি সার্থক জীবন খুঁজে পেত। এখনই ঘরকন্না শুরু করলে তার সম্ভাবনা সামান্যই। অল্পবিত্ত ঘরের বহু মেয়েই কিন্তু এখন কেরিয়ার তৈরি করছে। তার জন্য সরকারি, বেসরকারি নানা সাহায্যের সুযোগ রয়েছে। আপনি অধৈর্য হচ্ছেন বলে আপনার মেয়ের একটি সফল জীবন তৈরির আশা থাকছে না। দুই, আপনার মেয়ে যখন স্পষ্টই বিয়েতে অনাগ্রহী, তখন ওকে জোর করে বিয়ে দিলে সংসারজীবনে সে অসুখী হতে পারে। এমনকী, পারিবারিক অশান্তির জেরে তাকে বাপের বাড়ি ফিরেও আসতে হতে পারে। বহু মেয়ের জীবনেই এমন হচ্ছে। আজ আর মেয়ে ‘পার করে’ বাবা-মা দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারেন না। তিন, এত অল্প বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে নিজের মতামত স্পষ্ট করে বলার জোর পায় না। বিশেষত যেখানে আপনিই ওর কথা শুনছেন না, সেখানে স্বামী-শাশুড়ি শুনবেন, এমন সম্ভাবনা কম। আপনার ষোলো বছরের মেয়ে হয়তো ১৭-১৮ বছর বয়সেই মা হবে, তার ফলে তার দেহ ও মনের স্বাস্থ্য খারাপ হবে। আর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এই যে, আপনার মেয়ে অনিচ্ছায় বিয়ে করে সংসারের বোঝা বইতে বইতে বারবার আপনাকেই দোষারোপ করবে। এই কি সন্তানের ‘মঙ্গল’ যার জন্য তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করা চলে? আপনার ভুল হচ্ছে এইখানে যে, আপনি ধরেই নিয়েছেন আপনার মেয়ের জীবন আপনার জীবনের মতোই হবে। আপনি সম্ভবত অল্প বয়সে বিয়ে করে ঘরসংসার করেছেন, তাই মেয়েকেও তেমনই জীবনে বেঁধে দিতে চাইছেন। আপনার আশেপাশের মেয়েদের দেখুন - তারা অনেকেই পড়াশোনা করে, কাজ শিখে, নিজের জীবন নিজেরা তৈরি করছে। সংসারও করছে। আপনার মেয়ের উন্নতির দরজা আটকে আপনি কেন দাঁড়াচ্ছেন? মনে রাখবেন, আপনার সন্তান আপনার সম্পত্তি নয়। তাকে দিয়ে আপনি আপনার ইচ্ছে মতো কাজ করাতে পারেন না। আপনার কর্তব্য, তাকে উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া, যাতে সে নিজের ইচ্ছেমতো জীবন গড়ে নিতে পারে। মেয়ের উপর বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করা এখনই বন্ধ করুন। আপনার স্বামীর সঙ্গে, আপনার মেয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিন। আপনার জেদ আপনার সন্তানের অমঙ্গল করবে, তাকে অসুখী করবে, এমন সম্ভাবনাই বেশি।
তোমাকে বলছি
বাধা যত জোরদার হয়, লড়াইও তত কঠিন হয়। তা বলে লড়াই ছেড়ে দেওয়া চলে না। মনে রেখো মেয়েদের জীবন মানেই ঘরে-বাইরে যুদ্ধ। কখনও পরিবারের সঙ্গে, কখনও সমাজে-কর্মক্ষেত্রে লড়াই করে দাঁড়াতে হয়। তোমার বয়স অল্প, কিন্তু তোমার বক্তব্যে যথেষ্ট জোর রয়েছে। তোমার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ঠিক। আইন, পুলিশ, প্রশাসন তোমার পক্ষে রয়েছে। বালিকা বিবাহ প্রতিরোধের দায়িত্ব রয়েছে প্রতি জেলার সমাজ কল্যাণ দফতরের উপর। নিকটতম থানাও তোমার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। এ ছাড়া দিন-রাতের যে কোনও সময়ে ফোন করো ‘চাইল্ডলাইন’-এ, নম্বর ১০৯৮। যিনি ফোন ধরবেন, তিনি তোমাকে পরামর্শ দেবেন, কী কী করতে হবে। মনে রেখো, পরিবার বিমুখ হলেও তোমার পাশে দাঁড়ানোর লোক রয়েছে অনেক - তোমার আত্মীয়-বন্ধুরা, স্কুলের শিক্ষকরা, পঞ্চায়েত সদস্য, বিধায়ক বা সাংসদ, সকলেই কিন্তু তোমাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে দায়বদ্ধ। ভয়, সংকোচ দূর করে নিজের জীবন নিজের হাতে নাও। তুমি সফল হবে।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.