স্বয়ং মনসুর আলি খান পটৌডির মৃত্যুর পরেও যখন ভারতের খেলা প্রথম টেস্টে কোনও রকম আনুষ্ঠানিক শোকজ্ঞাপন করেনি তাঁরই শহরের মাঠ কোটলা। তখন পিটার রোবাকের মৃত্যুতে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু’দল ইডেনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, ভাবতেই পারছি না। ক্রিকেট প্রশাসকদের ঔদাসীন্যে অবশ্য এই মুহূর্তে কিছু এসে যাচ্ছে না। রোববার এমন ছুটির দিনেও রোবাক-মৃত্যু ঘিরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহলে যা বিস্ফোরণ তাতে যাবতীয় ক্রিকেট প্রেসবক্স-সহ যেখানে যেখানে ক্রিকেট খেলা হয়, তার মেজাজ এমনিই অর্ধনমিত। বরেণ্য ক্রিকেটাররা পর্যন্ত হতচকিত এক ক্রিকেট সমালোচকের মৃত্যুতে। স্টিভ ওয় থেকে ইয়ান চ্যাপেল সবাই একমত, আধুনিক ক্রিকেট তার সেরা লিখিয়েকে হারাল।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নিজের ব্যক্তিগত ভাবে রোবাকের মর্মার্থ অনুসন্ধানে কোনও স্পৃহা থাকার কথা নয়। যদিও তাঁর জায়গায় অনিল কুম্বলে অধিনায়ক থাকলে কী হত, কৌতুহল থেকে গেল। শেষ যে বার ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল, সাইমন্ডস-ভাজ্জি সংঘাত এবং ওই তীব্র উত্তপ্ত পরিবেশে ভারতের হয়ে গর্জন করেছিল রোবাকের কম্পিউটার। ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর প্রথম পাতায় রোবাক লেখেন, “ওহে পন্টিং, ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের সম্মান। এ বার গদি ছাড়ো।” যে সময়ের কথা তখন ভিডিও গেমসেও অস্ট্রেলিয়া ৪৭ অল আউট হয় না। পন্টিংরা তখন ক্রিকেটবিশ্বে একই সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর। সেই সময় ভিনদেশের ক্রিকেটলিখিয়ে হিসেবে সিডনিতে চাকরি করে সিডনিবাসী পন্টিংকে ওই রকম আক্রমণ করাঅকল্পনীয় বুকের পাটা দরকার। মাসখানেক পরে ধোনিদের নতুন অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় আবার রোবাকের স্মৃতিজনিত বিষণ্ণতা সিডনি-মেলবোর্নের প্রেসবক্সকে আক্রমণ করতে বাধ্য। অক্সফোর্ডজাত ইংরেজ লেখকের সেটাই হবে সর্বোচ্চ শোকগাথা।
রোবাক সমকামী ছিলেন না উভকামী? আত্মহত্যা করেছেন না চক্রান্ত? না কি স্বাভাবিক মৃত্যু? এগুলো তো অনুষঙ্গ। যার সত্যানুসন্ধান দিয়ে কী আসে যায়। পিটার রোবাকের সেই ভিন্টেজ ল্যাপটপ আর গর্জন করবে না, এর চেয়ে মর্মান্তিক কোনও কিছুই হতে পারে না আধুনিক ক্রিকেট মিডিয়ায়। গুগলে রোববার রাতে একটা হেডলাইন দেখলাম। ‘পিটার, উই হার্ডলি নিউ ইউ। বাট ইউ টোল্ড দ্য গেম লাইক নো আদার।’ ভারতীয় সাংবাদিকরা যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁদের মনে হবে এর চেয়ে সত্যি কথা আর হয় না। অত্যন্ত ভাল ব্যবহার, সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ভারত সম্পর্কে অপরিসীম আগ্রহ, অথচ কোথাও যেন মানুষটা নিঃসঙ্গ আর কিছুটা খেয়ালি ছিলেন। প্রেসবক্সে তিনি ঢোকামাত্র জমে যেত। কিন্তু রাতের কোনও আড্ডায় তাঁকে দেখেছি বলে মনেই করতে পারছি না। ১৯৯৯-এ তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম কিছু শিশুকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আসে। এর বছরখানেক বাদে ইয়ান বোথাম তাঁর বইতে লেখেন, ‘রোবাক লোকটা সম্পূর্ণ অদ্ভুত। ওর বাড়িতে এক বার আমায় ডেকেছিল। গিয়ে দেখি গেরুয়া পরে ধ্যান করছে। আর সে ভাবে টানা বসেই রইল। আমি আসা সত্ত্বেও চোখের পাতা খুলল না।’ রোবাককে তাঁর প্রাক্তন কাউন্টি-মেটের পর্যবেক্ষণ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, “বোথামের সমস্যা হল গল্পগুলোও যথেষ্ট রংদার করতে পারে না।” যৌন হেনস্থা নিয়ে স্বভাবতই জিজ্ঞেস করা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস বরাবর লক্ষ্য করা গিয়েছে। জিম্বাবোয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এই দুটো দেশের অনাথ শিশুদের জন্য প্রচুর কাজকর্ম করেছেন রোবাক। আনন্দবাজারের খেলার পাতায় যখনই লিখেছেন, সেই টাকা অকাতরে দান করে দিয়েছেন শিশুদের চ্যারিটি তহবিলে। চোখের সামনে দেখা। রবিবারও হর্ষ ভোগলে বলছিলেন, “জিম্বাবোয়ে গেলে কখনও দেখে আসবেন রোবাক শিশুদের জন্য কত সব কাজকর্ম করেছেন।” এত কিছু দেখেশুনেটুনে সত্যিই প্রশ্ন জাগে, কোনটা সত্যি? আলো না আঁধার? নাকি দুটোই? একটা ব্যাপারে আলো-আঁধার নেই। আধুনিক ক্রিকেটলিখিয়েদের সংসারে বটগাছ উৎপাটিত হল।
নেভিল কার্ডাসের মতোই ব্যক্তির মধ্যে জাতিকে দেখতেন রোবাক। ক্রিকেটীয় স্ট্রোকের মাধ্যমে খুঁজে নিতেন সেই দেশের ইতিহাসকে। সচিনের স্ট্রোকবাজি নিয়ে লিখতেন, “সচিন হল সুখী, স্বাধীন ভারতের অভিব্যক্তি। ও এমন একটা সময় খেলছে যখন ভারতের পারমাণবিক বোমা রয়েছে। বেশ কিছু বিলিওনেয়ার আছে। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সচিনের পূর্বসুরি গাওস্করের আমলে মারমুখী ক্রিকেট সম্ভব ছিল না। গাওস্করকে যুগের প্রয়োজন মেটাতেই ভারতীয় ক্রিকেটের স্বাধীনতা সংগ্রামী হতে হয়েছে।” এই পর্যন্ত কোথাও যেন আধুনিক সময়ের কার্ডাস। কিন্তু এর পর তাঁকেও অতিক্রম করে যাচ্ছেন তিনটি বাড়তি দৃষ্টিকোণে।
সাহস। একনিষ্ঠ সত্যানুসন্ধান। গভীর ক্রিকেটীয় মনন।
সমারসেট ক্যাপ্টেন থাকার সময় যিনি ভিভ-বোথামের সম্মিলীত পাঙ্গা সহ্য করেছেন। তাঁর ক্রিকেট লেখনী যে প্রবল খরস্রোতেও নির্ভীক থাকবে, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এটা সত্যিই অনবদ্য যে, কাউন্টি ক্রিকেটে ১৮ হাজার রান। মরসুমে বারো বারের মধ্যে ন’বার হাজার রান পূর্ণ করার অভিজ্ঞতা। এবং ক্রিকেট সার্কিটে অবাধ ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও লেখায় কখনও তার অবৈধ ছায়াপাত ঘটাননি। তিন মহাদেশ মিলিয়ে এত অগণিত পাঠকসংখ্যা কার্ডাসেরও ছিল না, যাঁরা প্রতি মুহূর্তে টিভি এবং নেট ঘেঁটে ঠিক কী ঘটেছিল জেনে নেওয়ার আর প্রত্যক্ষ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যদি হেলমেট পূর্ব এবং উত্তর দু’ভাগে ক্রিকেট রেকর্ডকে বিভক্ত করার কথা বলেন, তা হলে ক্রিকেট সাংবাদিকতাকেও দু’ভাগে ভাগ করা উচিত। লাইভ টিভি পূর্বক এবং পর।
সে দিনই প্রাক্তন এক উইজডেন সম্পাদক বলছিলেন, এমট রবিনসন নিয়ে কার্ডাস মজার মজার কিছু ব্যক্তিগত কথা লিখেছিলেন। যা পড়ে রবিনসন সেই সম্পাদকের দাদাকে বলেন, “লোকটাকে তো আমি চিনিই না। ও আমার সম্পর্কে এত কথা জানল কী করে?” কার্ডাসকে বলা হল। উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “অভিযোগ জানানোর কী আছে? চিনি বা না চিনি, আমি তো রবিনসন সম্পর্কে ভাল ভাল কথাই লিখেছি।”
আধুনিক ক্রিকেট দুনিয়া তাই কার্ডাসকে মহান ক্রিকেট নাট্যকার বলে বিদ্রুপ করে। মহান ক্রিকেট লেখক বলে না। তাঁর আমলের সর্বোচ্চ বিতর্ক বডিলাইনের সম্পর্কে একটা লেখাতেও না রয়েছে কার্ডাসের সরব প্রতিবাদ। না সর্বোচ্চ প্রশংসা। বাকি লেখাতেও অতিরঞ্জন। ঘটনার চেয়ে নাটক এবং সাহিত্যের প্রতি অনর্গল ঝুঁকে থাকা।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক রোবাক লিখেছেন তুলনামূলক ভাবে অনেক কঠিন সময়ে। যখন বিশ্বে খবরের দরজা খুলে গিয়েছে। অথচ মৃত্যুর পরেও দেখছি রোবাকের শ্রেষ্ঠত্বকে আক্রমণ করার কোনও ছিদ্র খোলা নেই। টেকনিক্যাল বুনন। স্টিভ ওয়ের মতো মানুষ অকাতরে বলেছেন, ক্যাপ্টেন থাকার সময় তিনি মুগ্ধচিত্তে রোবাক পড়তেন দিনের খেলার খুঁটিনাটি দিকগুলো সম্পর্কে আরও অবহিত হওয়ার জন্য। শরীরী ভাষাগুলো আরও ভাল বোঝার জন্য। একই মত পোষণ করেন শেন ওয়ার্ন। যিনি বাকি ন’শো নিরানব্বইটা ব্যাপারে স্টিভের চেয়ে অন্য মেরুতে। ক্রিকেটারকে পরামর্শ। অপ্রিয় সত্য সটান বলা। কবিত্বের ছোঁয়ায় তিরিশ বছরেরও বেশি ক্যাপটিভ অডিয়েন্স রক্ষা করে যাওয়া। ক্রিকেট সাংবাদিকতার সচিন তিনিই। এত নিশ্চিত যে, তর্কযোগ্য শব্দটা যোগ করার প্রয়োজনও দেখছি না। চ্যানেল নাইনের দেশের যুগন্ধর অধিনায়ক যদি বলেন, অমুকের লেখাটা পড়তাম দিনের খেলাটা আরও ভাল করে বোঝার জন্য, তার চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?
কেপটাউনের সাদার্ন সান হোটেলে ছিলেন শুনে অবাক লাগছে। অথচ ভারতে ইচ্ছাকৃত সস্তার হোটেলে উঠতেন। রোবাকের যু্ক্তি ছিল, পাঁচতারার বিলাসে তাঁর ভারতের আত্মা-উদ্ঘাটন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। প্রায় ভাঙা একটা কম্পিউটার ছিল রোবাকের। মেলবোর্ন প্রেসবক্সে এক বার এই সাংবাদিকের হাতে লেগে পড়ে যাওয়ায় ওটা পুরো ভেঙে যায়। রোবাক এমন ভেঙে পড়েন যে, সহকর্মীরা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিল, ভালই তো হল। নতুনটার আগমন অবশ্যম্ভাবী হল। রোবাক ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, “অতীত ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলতে চাই না।” পরের দিন ওটাকেই মেরামত-টেরামত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রেসবক্সে। আজ মনে হচ্ছে সচিনের ব্যাটের মতো ওটারও জায়গা হওয়া উচিত কোনও অভিজাত ক্রিকেট জাদুঘরে।
টি-টোয়েন্টি কভার করতেন না রোবাক। দু’দেশের মধ্যে ওয়ান-ডে সিরিজ কখনও নয়। একমাত্র বিশ্বকাপ। আর গুরুত্বপূর্ণ সব টেস্ট। মাঠের বাইরে কী ঘটছে কখনও কর্ণপাত করেননি। ড্রেসিংরুমের ব্যাপার-স্যাপারে আগ্রহ ছিল না। বলতেন, “আমার কাছে ক্রিকেট সকাল সাড়ে ন’টা থেকে দিনের পরবর্তী ৯০ ওভার পর্যন্ত। ওইটুকুই আমার সীমানা। ওটা দিয়ে যদি সচিন তেন্ডুলকরের জিনিয়াস ব্যাখ্যা করা যায়, বাকিদেরও যাবে!”
শততম সেঞ্চুরি হলে অনেক উপঢৌকন বাড়তি পাবেন সচিন। কিন্তু কোথাও মনে হচ্ছে সেগুলো সবই টাকার মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। টাকা কিনতে পারবে না এমন একটা উপহার কিন্তু তিনি হারালেন।
কীর্তি-পরবর্তী রোবাকের একটা লেখা! যা ক্রিকেটবিশ্বে এত বেশি পাঠকের গোগ্রাসে গেলার বস্তু ছিল যে, মর্মান্তিক ক্ষতি। মহাকীর্তিটা তাই থেকেই যাবে, বিষণ্ণতার একটা ভাঙা টুকরোকে পাশে নিয়ে। যার নাম রোবাক। |