শাদির মণ্ডপ।
শততম সেঞ্চুরির অমর বেদি।
দুর্ঘটনা আর ক্রিকেটলিখিয়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে শোকযাপন।
এত রকম সব রং মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সোমবার থেকে শুরু ইডেন টেস্ট নিয়ে যে, মনে হচ্ছে না ক্রিকেট ম্যাচ। মনে হবে ক্রিকেট শো। পাঁচ দিন ধরে ইডেন আর কলকাতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে আসছে। হালফিলে ইডেনে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের আগমন মানেই অবধারিত বাইশ গজ নিয়ে জল্পনা। এই বোধহয় ভারত অধিনায়ক আবার কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করলেন পিচ নিয়ে। দল বোধহয় চটে রয়েছে। রবিবার, টেস্ট শুরুর আগের দিন পিচ নিয়েও আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার রেশ নেই। বরং পরিচিত সিএবি কর্তাকে ধোনি পরামর্শ দিয়ে গেলেন, “কিউরেটরকে খেপিয়ে দিয়ে তো লাভ নেই। বুঝিয়ে-শুনিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। বুঝতে হবে তিনিও তো আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আমাদের ভালই চান।”
টিম হোটেলে দাঁড়ালে মনেই হবে না যে, ইডেনে গ্যালারি ফাঁকা থাকার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তার এমন কড়াকড়ির মধ্যেও প্রিয় তারকারা লবিতে নামলেই ক্রিকেটভক্তরা এমন ভিড় করে ঘিরে ফেলছে যে, ভাবাই কঠিন এঁরা দলে দলে সোমবার থেকে মাঠে হাজির হবেন না। বিশেষ করে যেখানে কোনও এক সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরির মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী থাকার এমন লটারি হাতে পাওয়া গিয়েছে। নানা রঙের মধ্যে নিঃসন্দেহে এটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল রং। সবথেকে জনপ্রিয় আর্তি। শনিবার সন্ধ্যায় সচিন সিটি সেন্টারের রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। সেখানে ভক্তরা ছেঁকে ধরে বলেছে, শততম সেঞ্চুরি চাই। এ দিন কালীঘাটে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। এত ভিড় হয়ে যায় যে, গাড়ি থেকে নামতেই পারেননি। ভিভিএস লক্ষ্মণ বিকেলের দিকে গিয়ে দিব্যি পুজো দিয়ে এলেন। পরিস্থিতি এমন যে, শহরের এক পরিচিতকে ফোন করে রাত্তিরে সচিন বলেছেন, ভোরবেলায় কালীঘাটে পুজো দিয়ে তাঁর কাছে সেই প্রসাদী ফুল পৌঁছে দিতে! |
এমনিতে দুর্দান্ত একটা সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে ধোনি। ইংল্যান্ডে যিনি ০-৮ হেরে ফিরেছিলেন। আর ঘরের মাঠে ৮-০ করার অভিনব হাতছানি। ইংল্যান্ডকে পাঁচ ম্যাচের এক দিনের সিরিজে ৫-০ হারিয়েছেন। এখানে ডারেন স্যামির ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন টেস্টেই হারাতে পারলে পাল্টা ৮-০ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধোনিকে এই সম্ভাবনার সামনে একেবারে চাপমুক্ত মনে হবে। কলকাতা পুলিশের পদস্থ অফিসারকে এ দিন বলে ফেললেন, “আপনাদের মোটরবাইকগুলো আমি দেখছিলাম। এক দিন চালাতে চাই।” অফিসার তক্ষুনি বলে দিলেন, “এনি ডে।”
কিন্তু সচিন তেন্ডুলকরের জন্য প্রাক-ম্যাচ আবহ দেখেই মনে হচ্ছে, তাঁর ‘ম্যাচ’ শুরু হয়ে গিয়েছে। মাঠে প্র্যাক্টিসের ফাঁকফোকরে পরিচিত ক্রিকেটকর্তারা তো বটেই। পুলিশকর্মীরা পর্যন্ত হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেঞ্চুরিটা এখানেই করে ফেলুন। টিম হোটেলের কথা তো ছেড়েই দিন। দোতলার ঘর থেকে সবার নামার লাইসেন্স আছে। তাঁর নেই। প্র্যাক্টিসে বেরনোর জন্য বা ফেরার সময় যখনই লবিতে তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। সেই ঠেলাঠেলির মধ্যেই এক ক্রিকেটভক্তের আবেদন, “ইডেনে আমরা বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখতে পাইনি। আইসিসি ছিনিয়ে নিয়েছিল। সচিন, আপনার সেঞ্চুরিটা হলে সব আক্ষেপ ধুয়েমুছে যাবে।” কলকাতার এক প্রাচীন ক্লাব আগাম সংবর্ধনার অনুরোধ পাঠিয়ে রেখেছে। কলকাতার খুব পরিচিত বন্ধুবান্ধব সেই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। তিনি সচিন তেন্ডুলকর তাঁদের ‘হ্যাঁ’ বলতে চান। কিন্তু এখনও বলতে পারেননি। শততম সেঞ্চুরির গাঁটটা আগে পেরোতে চান। তার পর যত যা অনুষ্ঠানাদি আছে, দেখা যাবে।
দেখে মনে হবে, ভক্তদের বোলিংটা খেলে দেওয়াই এখন তাঁর সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বাইশ গজে ফিডেল এডওয়ার্ডসকে সামলানোর কাজটা তুলনায় অনেক সহজ। পিটার রোবাক যাঁর রহস্যজনক মৃত্যুতে গোটা ক্রিকেটবিশ্ব এ দিন তোলপাড়, তাঁর একটা লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে নিরানব্বই সেঞ্চুরির মালিকের। তিনি যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কুড়ি বছর পার করলেন তখনকার লেখা। যেখানে রোবাক লিখেছিলেন, ‘কুড়ি বছর ধরে সচিন তেন্ডুলকরকে একার কাঁধে যে রকম চাপ সামলাতে হয়েছে, ভারতবর্ষে আর কাউকে হয়নি।’ রবিবার সন্ধ্যায় টিম হোটেলে বসে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বললেন, “ওই লেখাটার কথা আমি শুনেছি। আমাকে আগেও অনেকে বলেছে। কিন্তু পড়া হয়নি।”
রোবাকের মৃত্যুর খবর সকালে প্র্যাক্টিসে যাওয়ার আগে টিভি-তে দেখেছেন তিনি। বিস্মিত তিনি সন্ধ্যায় বসেও বলছিলেন, “বুঝতেই তো পারছিলাম না কী করে ঘটনাটা ঘটল।” তখনও যৌন সংসর্গের দিকটা বেরিয়ে পড়েনি। সচিন বলে যাচ্ছিলেন, “আমি খুব ব্যক্তিগত ভাবে রোবাককে চিনতাম না। আমার সঙ্গে দেখাও হয়েছে খুব কম। তবে ক্রিকেটলেখক হিসেবে শ্রদ্ধা করতাম। খুব ভাল ক্রিকেট বিশ্লেষণ করতেন। লেখাটাও দারুণ ছিল।” বোঝা গেল। কিন্তু তিনি শততম সেঞ্চুরির নিরন্তর চাপের মধ্যে কী করে নিজেকে ঠিক রাখছেন? শতকের শতকের আব্দারের উত্তরে কী বলছেন ভক্তদের? সচিন হাসেন। “আমি ম্যাচের উপর মনঃসংযোগ করছি। যেমন বরাবর করে এসেছি। আর ভক্তদের বলছি, হওয়ার হলে ঠিকই হয়ে যাবে।”
এই হল মোটামুটি টেস্ট শুরুর আগের দিন শততম সেঞ্চুরির বেদি। পুজোর ফুল, প্রার্থনার ডালি আর ক্রিকেট-আলপনায় যার সাজসজ্জা তৈরি। যার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ডারেন স্যামির দ্বীপ সেন্ট লুসিয়ায় ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি। গিরিশৃঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস পড়ে যায় সমুদ্রে। সতেরো জন মারা যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক সাংবাদিক সম্মেলনে এসে প্রথমেই তাঁর শোকর্বাতা পড়ে শোনালেন। ও দিকে রোবাকের বিস্ময়কর মৃত্যু। রাহুল দ্রাবিড় হোটেলে বসে সচিনের মতোই বিস্মিত ভাবে বলছিলেন, “আমিও সকালে দেখলাম। কিন্তু কোনও ক্লু-ই তো পাওয়া যাচ্ছে না!” দ্রাবিড় যোগ করলেন, “আমার দেখা অন্যতম সেরা ক্রিকেটলেখক। রোবাকের একটা বলিষ্ঠ মতবাদ ছিল কিন্তু সেটা খুব স্বাধীন মতবাদ ছিল। কারও দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। আর ভাষার ওপর ও রকম দখল! খেলার ছবিটাকে ও ভাবে ফুটিয়ে তোলা! জানি না আর ক’জনের আছে!”
এর পাশাপাশি শাদির মণ্ডপ। সেটা আর কিছুই নয়, ভারতীয় ক্রিকেট দল। মজা করে এখন এই নামে ডাকা হচ্ছে। গৌতম গম্ভীর সদ্য বিয়ে করে এসেছেন। এ দিনই চেন্নাইয়ে বিয়ে সেরে বেশি রাতে টিম হোটেলে ঢুকলেন নতুন স্পিন-বিস্ময় রবিচন্দ্রন অশ্বিন। দিল্লিতে গম্ভীরের বিয়ের পার্টিতে তাঁর দলের সতীর্থরা কেউ যেতেই পারেননি। কলকাতায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলছিলেন সবাই। রবিবার রাতে তাই টিম হোটেলেই তিনি ডিনার দিলেন। আর সেই ডিনারে যেতে যেতে কেউ মন্তব্য করলেন, “ভাই, এর পর কে আছ লাইনে? অশ্বিন কখন ঢুকছে? ওকেও বলো পার্টিটা এখানেই দিয়ে দিক।” কেউ মজা করে বললেন, “বেচারা স্পিনার আমাদের। বিয়ে করে পরের দিনই আসতে হচ্ছে খেলতে। তা-ও নতুন বউকে ছেড়ে। বলটা ঠিক মতো করলে হয়!”
ক্রিকেটের দুর্গম পথে ফেরার জন্য অশ্বিনের অব্যর্থ দাওয়াই হতে পারে তাঁর এক সিনিয়রের ঘর। ইডেনের সফলতম ব্যাটসম্যান। ভিভিএস লক্ষ্মণ। অশ্বিন যদি শাদির মণ্ডপ থেকে ফিরে সটান লক্ষ্মণের ঘরে ঢুকে পড়েন তা হলে দেখবেন, ঘরে কোনও খাট নেই। মেঝেতে একটা বিছানা পাতা। শুনবেন সদাহাস্যময় হায়দরাবাদি এর পরেও কোনও অভিযোগ করছেন না। বলছেন, “এটাই এখন আমার রুটিন। মেঝেতে বিছানা পাতা ছাড়া উপায় কী!” বেডসাইড টেবিলটা আছে আর সেখানে সাঁইবাবার ছবি। পাশে রুদ্রাক্ষের মালা। আমিষ খাবারের ছোঁয়াও তাঁর প্লেটের আশেপাশে লাগানো যাবে না। সকালে উঠে ভজন শোনেন। তার পাশেই আবার নেটপ্যাড। ইন্টারনেট নিয়ে বসে পড়ছেন। অশ্বিনরা তো তাঁর কাছ থেকে শিখতেই পারেন কী করে ধর্মের ব্যাপারে গোঁড়া থেকেও বাস্তব একটা জগত তৈরি করে ফেলা যায়। কী করে ক্রিকেটের জাঁকজমক ছেড়ে ক্রিকেট-আত্মত্যাগে নিজেকে উৎসর্গ করা যায়। তার চেয়েও বেশি করে যেটা মনে হচ্ছে, কোনও ফিডেল এডওয়ার্ডসের একটা বল আচমকা নিচু হয়ে বা লাফিয়ে উঠে যদি শততম সেঞ্চুরির প্রাণভোমরা কেড়ে নেয়, ইডেন সাময়িক নিস্তব্ধ হয়ে পড়বে ঠিকই। পুরোপুরি অন্ধকার হবে না।
কারণ ভিভিএস লক্ষ্মণ আছেন। মানে শিল্প আছে! জাদু আছে! |