পুলিশের লাল সাদা পাইলট কার ব্রেক কষল ঠিক মন্দিরের মূল ফটকের গা ঘেঁষে। পিছনের গাড়ির আরোহী অপলক তাকালেন ডান দিকে। বড়জোর মিনিট খানেকের নীরব প্রণাম। নিঃশব্দ প্রার্থনা গাড়ির ভিতর থেকেই। কে এসেছেন, কী জন্য এসেছেন, ততক্ষণে জেনে ফেলেছেন মন্দিরের সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটয়ে থাকা শ’খানেকের দঙ্গল। যাঁরা ততক্ষণে হাতে প্রসাদী ফুল নিয়ে তারস্বরে ‘একশো, একশো’ আওয়াজে ব্যস্ত। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে, পাইলট কারের ইঞ্জিন ওই স্টার্ট নিচ্ছে ফের। কালীঘাট মন্দিরের ঝটিতি সফর শেষে এই হোটেলের দিকে রওনা দিচ্ছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের বাহন।
ঠিক তার মিনিট কুড়ি আগের ছবি? দুপুর বারোটা কুড়ি-বাইশ হবে। এক একটা চেনা মুখ টিম বাসের দিকে এগোচ্ছে আর উৎসাহী জনতা চেঁচাচ্ছে। ওই তো বীরু, ওই তো দ্রাবিড়!
কিন্তু সচিন কোথায়? সচিন? তাঁকে দেখতেই তো সাত সকালে ইডেনে আসা। কথা মতো সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা বেড়েছে, প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁকফোকরও বেরোয়নি। ওই তো একটু আগে নকিং সেরে বেরোলেন। সবাই জানে, টিম বাসে প্রথম দিকের সিটেই বসা পছন্দ তাঁর। কানে থাকবে হেডফোন আর চোখে রোদচশমা। চারপাশ নিয়ে উদাসীন।
টিম বাস একসময় ছেড়ে দিল, আকুল জনতা দেখতেই পেল না তাঁকে। আসলে তাঁর গাড়ি যে ততক্ষণে সবার অলক্ষ্যে কালীঘাটের পথে। কে না জানে, সচিনের দুনিয়ায় কড়াকড়ি অনেক। অন্দরমহলে ‘মাগল’-দের মানে আমার-আপনার মতো সাধারণের উঁকিঝুঁকি নিষেধ। অনধিকার প্রবেশের প্রশ্নই নেই। |
হুবহু একই দিনলিপি এ দিনও। অবাঞ্ছিত উৎপাত ঘোর অপছন্দ। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কালীঘাট ঘুরে এসে একশোখানা একশো-র দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সচিন রইলেন টিম হোটেলের ২৪৯ নম্বর ঘরের নিরাপদ নিভৃতে। রাজমহলের বাইরে অবশ্য নিভৃত কোনও ব্যাপার নেই। সেখানে কাকভোর থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে ভিড়। যেমন কালীঘাটের মন্দিরের বাইরে। মুহূর্তে শ’পাঁচেকের ভিড়। যদি কপালজোরে ঘটে যায় এক ঝলকের রাজদর্শন। ছেলে-বুড়ো-আধবুড়ো, স্কার্ট-টপ-জিন্স-বেনারসী, সুট-টাইয়ের কর্পোরেট কর্তা থেকে হোমরাচোমড়া আমলাকুল---প্রত্যেকের একটাই প্রশ্ন। হবে তো? আর প্রার্থনা। ইডেনেই হোক। যে ভাবে মন্দির-মসজিদ গির্জায় লোকে স্থান কাল পাত্র ভুলে পড়ে থাকে প্রার্থিতের আশায়। দক্ষিণ শহরতলিতে যজ্ঞে বসেছেন এক সচিন ভক্ত, আবার কেউ ফেসবুকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন একশো হলেই নিজের নাম বদলে সচিন করে ফেলবেন। সাত সকাল থেকেই তো ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারে ক্লান্তিহীন পতাকা নাড়াচ্ছিলেন সচিন ভক্ত সুধীর গৌতম। টিভির সৌজন্যে যাঁর শাঁখের আওয়াজের সঙ্গে পরিচিত এ দেশের ক্রিকেট জনতা। যিনি সেঞ্চুরি হলেই নিজের বুক চিরে লিখবেন সচিনের নাম। বা টিম ইন্ডিয়ার প্র্যাক্টিসের সময় যে প্রতিবন্ধীকে মাঠের মধ্যে দেখা যায়, সেই ধরমবীর আবার ঠিক করে রেখেছেন
সচিনের সেঞ্চুরি মানেই দে দৌড় কালীঘাটে। আর্তি বলতে ২০১৫ পর্যন্ত থাকুন সচিন, আবার দিন একটা বিশ্বকাপ।
নির্যাস একটাই। ধূম লেগেছে গোটা দেশের সচিনপ্রেমীদের হৃৎকমলে! আর এমন অব্যর্থ লেগেছে, ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে অপেক্ষার ঘোর কাটতেই চাইছে না। ইডেন সোমবার সকালে হয়তো ভরবে না, কিন্তু আগে ভারত ব্যাট করলে লোকে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করবে দুটো উইকেট পড়ার জন্য। কখন প্যাড পরা তাঁর সাড়ে পাঁচ ফুটের চেহারাটা বেরোবে ইডেনের ড্রেসিংরুম থেকে। কখন পেরোবেন পঞ্চাশ, একটু একটু করে এগোবেন তিন অঙ্কের দিকে। সিএবি-র এক কর্তা বলছিলেন, “ইন্ডিয়াকে শুধু টসটা জিততে দিন। সচিন নামুক একবার, দেখব ক’জন তখন অফিসে থাকে!”
তাই পাড়ার রক থেকে অভিজাত ক্লাবের সান্ধবাসর, ফেসবুক-টুইটার থেকে হালের গুগল প্লাস, রবিবারের শহরে আড্ডা-আলোচনা-সংলাপের সিংহভাগ জুড়ে সচিন। আর সবার আকুতি, টসটা ধোনিই জিতুন।
আর হ্যাঁ, শুধু সচিন নন। কালীঘাট মন্দিরে আরও এক সেলিব্রিটি ভক্তের দেখা মিলল রবিবার। কুর্তা-পাজামা শোভিত ভিভিএস লক্ষ্মণ। ইডেন যাঁর অন্যতম প্রিয় ক্রিকেট চত্বর। লক্ষ্মণ মায়ের কাছে বিশেষ কিছু চাইলেন কি না জানা নেই। সচিন কী আর্তি নিয়ে এসেছিলেন সেটা অবশ্য আঁচ করা যাচ্ছে। আর দু’জনের মধ্যে কার প্রার্থিত বস্তুটা এই মুহূর্তে বেশি জরুরি, সেটা আন্দাজ করার জন্য একটা ললিপপও পুরস্কার নেই! |