ভারতীয় অর্থনীতি লইয়া চিন্তার কারণ ক্রমে বাড়িতেছে। যত দিন কেবলমাত্র মূল্যস্ফীতিই দেশের অভিভাবকদের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল, তত দিন তবু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াইলেই বোধ হইত, চিন্তার উপশমে কিছু অন্তত ব্যবস্থা হইল। কিন্তু, শিল্প উৎপাদনের সূচক আর সেই অবকাশ রাখিল না। সেপ্টেম্বর মাসের সূচক প্রকাশিত হইয়াছে। দেখা যাইতেছে, গত বৎসরের তুলনায় এই বৎসর শিল্প উৎপাদন বাড়িয়াছে মাত্র ১.৯ শতাংশ। ইহা প্রাথমিক হিসাব। অগস্ট মাসের সংখ্যায় দেখা যাইতেছে, প্রাথমিক হিসাবে বৃদ্ধির হার যত অনুমান করা হইয়াছিল, প্রকৃত বৃদ্ধির হার তাহার অপেক্ষা কম। সেপ্টেম্বরেও তেমন ঘটিবে না, নিঃসংশয় হইবার উপায় নাই। কেন হার এত কম? গোটা দুনিয়াতেই শিল্প উৎপাদন কমিতেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাও কমিয়াছে। এখন ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম ঐতিহাসিক ভাবে কম, তবুও রফতানির হার তলানিতে। বস্তুত, ইউরোপের অর্থনীতি এখন এমন বেকায়দায় পড়িয়াছে যে বেজিং-ও প্রবল চিন্তান্বিত। কাজেই, ভারতও বিপাকে পড়িয়াছে। বিশ্ব বাজারে কয়লার দাম চড়া, ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি পড়িয়াছে। আর, ভারতে শিল্প উৎপাদন হ্রাসের বৃহত্তম কারণ সম্ভবত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর আর্থিক নীতি। সাম্প্রতিক অতীতে ব্যাঙ্ক যে ভাবে সুদের হার বাড়াইয়াছে, তাহা অ-পূর্ব। শিল্পমহল বেশ কয়েক বার তাহাদের আপত্তি প্রকট করিয়াছে। কিন্তু ব্যাঙ্ক যেহেতু মূল্যস্ফীতির রাক্ষসবধে দৃঢ়চিত্ত হইয়াছিল, তাই সুদের হার ঊর্ধ্বমুখীই থাকিয়াছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অবশ্য ব্যাঙ্কের উদ্বেগের পরোয়া করে নাই। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১১.৮১ শতাংশ। ফলে, সব দিক হইতেই ভারত বেকায়দায়।
তাহা হইলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের কী হইবে? নয় শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা আর শোনা যায় না। মে-জুন হইতেই কর্তারা আট শতাংশের সুর ধরিয়াছিলেন। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালা বলিয়াছেন, বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশ হইতে ৮ শতাংশের মধ্যে থাকিবে। জি ডি পি’র চারটি ভাগ সাধারণ মানুষের ভোগব্যয়, সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ এবং উদ্বৃত্ত রফতানি। চড়া সুদের হার এবং আর্থিক সংকটের আবহে সাধারণের ভোগব্যয় প্রবণতা নিম্নমুখী হইয়াছে। সরকারও এই বার ব্যয়ের পরিমাণ কমাইতে বাধ্য, নচেৎ রাজকোষ ঘাটতির আর কোনও লাগাম থাকিবে না। চড়া সুদের হারের দৌলতে বিনিয়োগের বৃদ্ধি মৃদু হইয়াছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এই মুহূর্তে খানিক সংশয়ে আছেন বলিয়া বোধ হয়। আর, জুলাই মাস হইতে রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ টানা নিম্নগামী হইয়াছে। ফলে, জি ডি পি-র বৃদ্ধির হার বেশি না হওয়াই স্বাভাবিক। একটি কথা ক্রমে স্পষ্ট হইতেছে যে অভ্যন্তরীণ বাজার ভারতীয় অর্থনীতিকে ২০০৮ সালের মন্দার আঁচ হইতে অনেকখানি আড়াল করিয়াছিল, তাহার প্রতিরোধক্ষমতা কমিতেছে। মূল্যস্ফীতির চড়া হার সেই বাজারকে কাবু করিয়া ফেলিয়াছে। ফলে, ভারতীয় অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশি করিয়া বিশ্ব অর্থনীতির টানেই চলিবে। মূল্যস্ফীতির দানব দমন না করা পর্যন্ত নিস্তার নাই। কিন্তু, তাহার জন্য ভিন্নতর শরসন্ধান করিতে হইবে। কঠোর অর্থনীতি এই পরীক্ষায় ফেল করিয়াছে। সরকার যত দ্রুত এই সত্যটি উপলব্ধি করে, ততই মঙ্গল। |