দু’বেলাই তার প্রয়োজন। তাই প্রায় ঘরে ঘরে রান্নার গ্যাস। অথচ প্রায় কেউই নিরাপত্তা বিধির ধার ধারছেন না। ফলে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে গৃহস্থের হেঁশেল।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, রান্নার গ্যাসের ৯০ শতাংশ গ্রাহকই সুরক্ষা বিধি মেনে চলেন না।
আসলে হেঁশেল সুরক্ষিত করতে ঠিক কী কী করা উচিত, সেটা অনেকেরই জানা নেই। ১৯৮৮ সালে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক একটি আইন প্রণয়ন করেছিল। তাতে বলা হয়, প্রতি দু’বছরে অন্তত এক বার গ্রাহকের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে গ্যাসের ডিলারকেই দেখে নিতে হবে, কোথাও কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। থাকলে কী করণীয়, তখনই তা গ্রাহককে জানিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেই ‘ম্যান্ডেটরি চেকিং’ বা বাধ্যতামূলক পরীক্ষা কখনওই ঠিক ভাবে করা হয়নি। অথচ এই খাতে দু’বছরে এক বার গ্রাহকদের কাছ থেকে ৭০ টাকা নিচ্ছেন বহু ডিলার।
এক শ্রেণির ডিলার সম্প্রতি এই বাধ্যতামূলক পরীক্ষা শুরু করেছেন। এক বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়ে প্রত্যেক গ্রাহকের বাড়িতে এই পরীক্ষা করাচ্ছেন বেলঘরিয়ার এক ডিলার। এবং সেই পরীক্ষা করতে নেমে বিষাদ বসু নামে ওই সংস্থার এক প্রতিনিধির অভিজ্ঞতা, “বেলঘরিয়ার প্রায় ৩৫০০ এবং সোদপুরের ১২০০ বাড়িতে ঘুরে দেখা গিয়েছে, ৯০ শতাংশ গ্রাহকই নিরাপত্তা বিধি মানেন না।”
সুরক্ষা বিধি উপেক্ষা করা হচ্ছে কী ভাবে?
• সমীক্ষা জানাচ্ছে, অধিকাংশ হেঁশেলে ওভেন এবং সিলিন্ডারের মধ্যে নির্দিষ্ট মানের ‘সুরক্ষা পাইপ’ই নেই। এই পাইপের ভিতরে তারজালি দেওয়া থাকে। চেষ্টা করেও সেটা কাটা যায় না। কিন্তু সেই নিরাপদ পাইপের বদলে বেশির ভাগ গ্রাহকই ব্যবহার করেন বাজারচলতি সাদা, সবুজ সাধারণ পাইপ। তাতে বিপদ ঘটতে পারে যখন-তখন। যেমন মধুবন্তী চক্রবর্তী নামে দক্ষিণ কলকাতার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, তিনি সবুজ রঙের রবারের পাইপ ব্যবহার করেন। তবে সেটা মাঝেমধ্যে গলে যায়। তখন সেটা কেটে ছোট করে আবার ব্যবহার করা হয়। সুরক্ষা বিধি অনুযায়ী ওই পাইপ কিন্তু ব্যবহার করার কথাই নয়। তবু ওই ধরনের পাইপই ব্যবহার করেন বাগুইআটির মধুছন্দা গুপ্তও।
• গ্যাস লিক করছে কি না, নতুন সিলিন্ডার আসার পরে সঙ্গে সঙ্গেই সিল খুলে ওভেনের সঙ্গে লাগিয়ে সেটা দেখে নেওয়ার কথা। সমীক্ষা বলছে, ৯০ শতাংশ গ্রাহকই এটা করেন না। মধুছন্দাদেবী বলেন, “কোনও দিনই এটা করিনি। কখনও তো কোনও সমস্যা হয়নি।” দক্ষিণ কলকাতার গৃহবধূ মঞ্জু বসু অবশ্য নতুন সিলিন্ডার পরীক্ষা করে নেন। তাঁর কথায়, “আগে এক বার লিক করেছিল। তাই এখন পরীক্ষা করিয়ে নিই।”
• সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক রাতে শোয়ার আগে সিলিন্ডারের রেগুলেটর ‘অফ’ বা বন্ধ করেন না। গ্রাহকদের পাল্টা বক্তব্য, ঘনঘন অফ-অন করতে থাকলে রেগুলেটর আলগা হয়ে যায়।
মধুবন্তীদেবীর মনে পড়ে না, শেষ কবে তাঁর বাড়িতে ডিলারের তরফে বাধ্যতামূলক পরীক্ষা করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “গ্যাস সংক্রান্ত ছোটখাটো সমস্যা হলে আমরাই ঠিক করে নিই। প্রয়োজনে ডিলারের লোককে ডেকে পাঠানো হয়।” মধুছন্দাদেবীর বাড়িতেও এই পরীক্ষা কখনও হয়নি। মঞ্জুদেবী বলেন, “যত দূর মনে পড়ছে, বছর সাতেক আগে এক বার পরীক্ষা হয়েছিল। সেই প্রথম এবং এ-পর্যন্ত সেই শেষ।”
|
করবেন |
|
করবেন না |
• শক্তপোক্ত সুরক্ষা পাইপ চাই
• নতুন সিলিন্ডার ওভেনে লাগিয়ে দেখুন,
গ্যাস লিক করছে কি না
• প্রতি রাতে রেগুলেটর বন্ধ করুন
• রেগুলেটরের ‘ব্রিদিং হোল’ পরিষ্কার রাখুন
• ওভেনের নব পরিষ্কার রাখুন |
• রবারের নরম পাইপ নয়
• রান্নাঘরে ফ্রিজের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্র না-রাখাই ভাল
• রান্নাঘরে প্রদীপ বা অন্য কিছু জ্বালিয়ে রাখবেন না
• সিলিন্ডার কোনও বদ্ধ জায়গায় রাখবেন না |
|
সম্প্রতি এই পরীক্ষা শুরু হয়েছে সল্টলেকে। সেখানকার এক বাসিন্দার অভিযোগ, “পরীক্ষা করতে এসে প্রতিনিধি রান্নাঘরে ঢুকে মাত্র দু’মিনিট গ্যাস সিলিন্ডার নাড়াচাড়া করে, একটি কাগজে সই করিয়ে চলে গেলেন।”
অথচ বিষাদবাবুদের মতে, ঠিকমতো পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি বাড়িতে সময় লাগার কথা ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। রান্নাঘরে হাওয়া চলাচলের ভাল ব্যবস্থা রয়েছে কি না, সুরক্ষা পাইপ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না এই ধরনের ৪৩টি বিষয় পরীক্ষা করার কথা। অথচ তা মাত্র দু’মিনিটেই সেরে ফেলা হচ্ছে!
কী বলছেন গ্যাস ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিজনবিহারী বিশ্বাস?
বিজনবাবুর কথায়, “এটা অনুচিত। কোনও ডিলার অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করে দু’মিনিটে নমো নমো করে পরীক্ষা সেরে ৭০ টাকা নিয়ে আসছেন। প্রতিনিয়ত তাগাদা দেওয়ার পরেও ৮০ শতাংশ ডিলার বাধ্যতামূলক পরীক্ষা করাচ্ছেনই না।” যে-সব ডিলার এই পরীক্ষা করাতে চান, তাঁরা আবার অন্য এক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে বিজনবাবুর অভিযোগ। তিনি জানান, ৭০ টাকা দিতে হবে শুনে অনেক গ্রাহক পিছিয়ে যান। অনেকেই জানিয়ে দেন, গ্যাস নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। দরকার নেই পরীক্ষার। |