পশ্চিমবঙ্গ-সহ ২০টি রাজ্যে বিদ্যুৎ-মাসুল না বাড়ানোর ফলে সঙ্কটে পড়েছে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি। শুক্রবার তাই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ট্রাইব্যুনাল একতরফা ভাবেই বিদ্যুৎ-মাসুল বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনগুলিকে। কিন্তু একতরফা ভাবে মাসুল সংশোধনের এই নির্দেশ সম্পর্কে আপত্তি রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে কমিশনকে মাসুল বাড়ানোর অধিকার দেওয়ায় তাঁর সমর্থন নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করে কেন্দ্র প্রতিটি বিষয়ে মাথা গলাচ্ছে। এই জিনিস বারবার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। মমতা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ট্রাইব্যুনাল মাসুল সংশোধন সংক্রান্ত যে নির্দেশ জারি করেছে, জেলা সফরে থাকায় সে ব্যাপারে তিনি বিশদে জানেন না। কলকাতায় ফিরে এই বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেবেন।
সম্প্রতি পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও মমতা কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। কোনও আলোচনা ছাড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি পেট্রোলের দাম বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এর প্রতিবাদে তিনি কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসারও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। পেট্রোলের দাম বাড়ানোই হোক বা বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি এমনিতেই বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম চড়া। বিদ্যুৎ-মাসুল বাড়ালে সাধারণ মানুষের উপরে আর্থিক বোঝা আরও বাড়বে। এই যুক্তিতেই রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির মাসুল সংশোধনের আবেদনে সম্মতি দেননি তিনি।
কিন্তু মাসুল না বাড়ায় বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির যে বিপুল লোকসান হচ্ছে, তাতে লাগাম দিতে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। এর সূত্র ধরেই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ট্রাইব্যুনাল মাসুল সংশোধনের এই নির্দেশ দিয়েছে বলে বিদ্যুৎশিল্প মহল সূত্রে খবর। শুক্রবার ট্রাইব্যুনাল যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক আর্থিক বছরের শেষে পরের বছরের সংশোধিত মাসুল হার ঘোষণা করে দিতে হবে। কোনও বিদ্যুৎ সংস্থা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে মাসুল সংশোধনের আবেদন জমা না দিলে এক মাস অপেক্ষা করে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নতুন মাসুল ঘোষণার ব্যবস্থা করবে। কয়লা ও তেলের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি মাসেই ফুয়েল সারচার্জ স্থির করে দেবে কমিশন। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির কোনও ভূমিকা থাকবে না।
কমিশনের এই নির্দেশে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম এবং ডিপিএল-এর কর্তারা খুশি হলেও তাঁদের মনে সংশয় রয়েছে। কর্তারা মনে করছেন, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মতো রাজ্য নিয়ন্ত্রণ কমিশন একতরফা ভাবে মাসুল সংশোধনের নির্দেশ দিলেও রাজ্য সরকার তাতে বাধা দিতে পারে। রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তা জানান, রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন মাসুল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সাধারণ মানুষের উপরে যাতে সেই বাড়তি বোঝা না চাপে তার জন্য ভর্তুকি দেওয়ার কথাও ভাবতে পারে রাজ্য সরকার। কী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ধুঁকতে থাকা বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে চাঙ্গা করে তুলতে সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালকে চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সচিব উমাশঙ্কর। ওই চিঠিতে লেখা হয়, অন্তত ২০টি রাজ্যের বিদ্যুৎ-মাসুল সংশোধন আটকে রয়েছে। মাসুল না বাড়ানোয় দেশের ৩৯টি বণ্টন সংস্থার মধ্যে অন্তত ২২টি বিপুল লোকসানের কবলে। কেন্দ্রীয় সচিবের হিসেব মতো, ২০০৮-’০৯ আর্থিক বছরেই বণ্টন সংস্থাগুলির মোট ক্ষতি প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছিল। এর সঙ্গে পরের বছরগুলির লোকসান যোগ হতে হতে অঙ্কটা পৌঁছেছে এক লক্ষ কোটি টাকায়। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম-সহ দেনায় জর্জরিত কয়েকটি সংস্থাকে ব্যাঙ্ক আর ঋণ দিচ্ছে না। আবার টাকার অভাবে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো ঠিক মতো কয়লা কিনতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদনও। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সচিব উমাশঙ্কর ট্রাইব্যুনালকে মাসুল নীতির বিশেষ ধারা প্রয়োগ করতে অনুরোধ করেন। এই ধারা বলে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনগুলি নিজে থেকেই নতুন মাসুল ঘোষণা করার নির্দেশ দিতে পারে।
বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে খবর, ২০০০ সালের আগে এক বার একই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তখন ট্রাইব্যুনালের হাতে এত ক্ষমতা ছিল না। তাই তখন সব ক’টি রুগ্ণ সংস্থার দেনা মকুব করে তাদের নতুন ভাবে কাজ শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয়। সঙ্গে শর্তও জুড়ে দেওয়া হয় যে, ফি বছর সংস্থাগুলোকে মাসুল সংশোধন করতে হবে, যাতে আয়-ব্যয়ে সমতা রক্ষা করা যায়। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ সংস্থাই ওই শর্ত মানছে না। এই পরিস্থিতিতেই বিকল্প ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০০৩ সালের বিদ্যুৎ-আইনের ১২১ নম্বর ধারায় রাজ্য কমিশনকে একতরফা ভাবে মাসুল বৃদ্ধির নির্দেশ জারির অধিকার তুলে দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের হাতে। বস্তুত, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করেই এই ধারার প্রয়োগ করা সম্পর্কে আপত্তি রয়েছে মুখমন্ত্রীর। |