প্রবন্ধ...
আমি কোত্থাও যাব না
কোনও ফ্যাকড়া নেই, এই দেওদারতলায় বসে এখন আমি ডায়েরি লিখব। বটতলা অনেক দেখেছি, কিন্তু দেওদারতলা এই প্রথম!
পাহাড়ি দেওদারের ডালপালা বিশেষ থাকে না, সটান উঠে যায়। কিন্তু ৭৫০০ ফুট উঁচুতে বাংলোর বারান্দায় এ গাছের গুঁড়িটা ওক গাছের মতো বিশাল, মাথার ওপরে ঘন ডালপালায় সবুজ পাতার চাঁদোয়া। বাংলোর ম্যানেজার বলছিলেন, “এই রকম দেওদার দুনিয়ার কোথাও পাবেন না। গাছটার নামেই তাই বাংলোটার নাম। দেওদার ওক!”
গুঁড়িটা ঘিরে শানবাঁধানো গোল চাতাল। যত দূর দৃষ্টি যায়, পাহাড়ি খাদ আর সবুজ গাছের জঙ্গল। হলুদ ঠোঁট, নীলচে ডানার ছোট্ট এক পাখি ট্টি ট্টি করে ডাকতে ডাকতে সামনের ডাল ছেড়ে উড়ে গেল। এই বুঝি সেই ‘ব্লু হুইসলিং থ্রাশ?’ চিত হয়ে শুয়ে দেওদারের গায়ে হাত বোলালাম। বৃদ্ধ বটের মতো এবড়োখেবড়ো নয়, বেশ মসৃণ। রাস্কিন বন্ড লিখেছিলেন, ‘হাত দিয়ে ছুঁয়ে গাছ চেনা যায়। ওয়ালনাট সবচেয়ে মসৃণ, পাইন গাছে হাত দিলে পাকানো একটা প্যাটার্ন। আবার ওক গাছের গা এ সবের তুলনায় কর্কশ, অনেক অভিজ্ঞতা আর ঝড়ঝাপটার সাক্ষী সে।’ রাস্কিন বন্ডের সঙ্গে এক দিন দেখা করতে গেলে হয় না?
একটু আগে প্রকাশের দোকান থেকে চিজ কিনে ফিরেছি। আমি কোত্থাও যাব না, কলকাতাতেও ফিরব না। এখন এটা দিয়ে ওয়াইন খাব। প্রকাশ প্রায় একশো বছরের দোকান। মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু মসুরি (আমরা বলি ‘মুসৌরি’, ভুল বলি) এলে এখান থেকেই চিজ কিনতেন। দোকানে ঢুকছি, এক চেনা মুখ রুটি কিনে বেরোচ্ছেন। ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়! এখানেই থাকেন। ‘দেওদার ওক’-এর পিছনের বাংলোটাই প্রণয় আর রাধিকা রায়ের। পাশে দেব আনন্দের কন্যা। আর একটু এগিয়ে গেলে দুই ভাই স্টিফেন আর টম অল্টারের পারিবারিক বাংলো। অন্য দিকে সঞ্জয় নারাং একটি বাংলো কিনেছেন। শুনলাম, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সচিন তেন্ডুলকর প্রায়ই ছুটি কাটাতে আসেন। কাছেই থাকেন লেখক দম্পতি হিউ আর কলিন গ্যান্টজিয়ার। উল্টো দিকে, বনবাসার পাহাড়ে ‘ফুটলুজ অন হিমালয়াজ’-এর লেখক বিল এটকেন। রাস্কিন বন্ড অবশ্য বাংলো কেনেননি, বিশ বছর ‘আইভি কটেজ’-এর বাসিন্দা।
জায়গাটার নাম ল্যান্ডোর। মসুরি থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার, অথচ ভিড়ভাট্টা নেই। চার দিকে ওক, পাইন আর দেওদারের জঙ্গল, দূরে বরফঢাকা বন্দরপুঞ্ছ শৃঙ্গ!
ভিড় নেই, কেন না জায়গাটা এখনও সেনাবাহিনীর হাতে। সিপাহি বিদ্রোহেরও আগে ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য এখানে একটা স্যানাটোরিয়াম তৈরি হয়েছিল। এখন ভারতীয় সেনার ‘ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট’। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল, রেস্তোরাঁ গজিয়ে ওঠেনি। যে বাংলোগুলি রয়েছে, পুরনো কায়দায়, পুরনো নামে সযত্নে সাজানো। নতুন বাড়ি তৈরির অনুমতি এখানে নেই।
ভোরে হাঁটতে হাঁটতে চারদুকান গিয়েছিলাম। এটাই ল্যান্ডোরের প্রধান এলাকা। পাশাপাশি টোস্ট, ওমলেট, পিৎজা, চা-কফি বিক্রির চারটে দোকান, তাই এই নাম। সামনের রাস্তাটা বেয়ে সিধে নেমে গেলে মসুরি। গাড়িতে মিনিট কুড়ি। হাঁটাপথে বড়জোর এক ঘন্টা। কিন্তু আমি এখন মসুরি যাব না, পাশের ছোট্ট গির্জাটায় ঢুকব। আজ রবিবার, কয়্যার সং-এর আওয়াজ ভেসে আসছে। ১৮৪০-এ তৈরি গির্জা, রবিবারের প্রার্থনায় যোগ দিতে এসেছেন অনেকে। সামনের বেঞ্চে তিনটি দুরন্ত শিশুকে নিয়ে ক্ষয়াটে চেহারার এক মহিলা,
ও লর্ড, মেক মি অ্যান ইনস্ট্রুমেন্ট অব দাই পিস
হোয়্যার দেয়ার ইজ হেট্রেড, লেট মি সো লাভ।

এই গির্জাতেই বিয়ে করেছিলেন ওঁরা? উইলিয়াম ক্রিস্টোফার আর মেরি জেন করবেট। তেরোটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল, অষ্টম সন্তান আজও কিংবদন্তি। জিম করবেট!
আজ দুপুরে মসুরি নেমেছিলাম। হেঁটে হেঁটে। চমৎকার লাগছিল। পাথরে বাঁধানো রেলিং দেওয়া ছায়াপথ বেয়ে নামতে থাকা। দূরে লাল ছাদ, একটা মাঠ। উডস্টক স্কুল। নয়নতারা সহগল ওখানেই পড়তেন না? হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটার কথা মনে পড়ল। ‘শিবালিক পাহাড় পেরিয়ে, দুন উপত্যকা আর মসুরিকে পিছনে ফেলে সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে ওরা হাঁটছিল।’ রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর কিম! প্রথম নোবেলজয়ী ইংরেজ লেখক মসুরি খুব পছন্দ করতেন।
ল্যান্ডোরের সেই গির্জার ছবি।
তখন মসুরির মজাটাই আলাদা। সিমলা, দার্জিলিং-এ গ্রীষ্মকালে ছোটলাট ও তাঁর সঙ্গীরা বেড়াতে যান, রাজধানীর প্রশাসনিক ব্যস্ততা চলে। কিন্তু মসুরি পাহাড়ে সে ঝঞ্ঝাট নেই, ফলে রাজাবাদশা ও রহিস আদমিদের প্রথম পছন্দ এটাই। মসুরির হোটেলে তখন ‘সেপারেশন বেল’ বাজে। স্বামী প্রবাসে বা যুদ্ধে, ইংরেজ স্ত্রী চলে এলেন পাহাড়ে। অন্য দিকে রয়েছেন সদ্য ইংল্যান্ড থেকে আসা যুবকরাও। ফলে ভোরবেলা ‘সেপারেশন বেল’, মানে, এ বার নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমোন! ১৮৪৪ সালে খবর, মসুরির ফ্যান্সিবাজারে নিলামে চুমু দিচ্ছেন এক সুন্দরী। প্রতি চুমুর দাম ৫ টাকা! এখন ফ্যান্সিবাজারে বাঙালি টুরিস্টের ভিড়, ‘অ্যাই, মেজদির জন্য সোয়েটার কিনতে হবে কিন্তু।’
ল্যান্ডোরে সকলেই দেখছি, লেখাপড়ায় ব্যস্ত। বিভিন্ন জায়গায় বই নিয়ে বসে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা তরুণতরুণী। এখানেই ব্রিটিশ আমলের ‘ল্যান্ডোর ল্যাঙ্গোয়েজ স্কুল’। সাম্রাজ্য শাসন করতে দেশজ ভাষা শেখা তখন জরুরি। আজও সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, গাড়োয়ালি শিখতে সারা দুনিয়া এখানে আসে।
অধ্যক্ষের নাম চিত্তরঞ্জন দত্ত। প্রথমেই জানালেন, “আমি কিন্তু গাড়োয়ালি।”
‘আপনারা বাংলা শেখান না?’
কফির কাপে চুমুক দিয়ে চিত্তরঞ্জন হাসলেন, “আগে শেখানো হত। বিদেশিরাও শিখতে চাইত। এখন ছাত্র পাওয়া যায় না।”
‘কোন ভাষা শিখতে আগ্রহ বেশি?’
‘সংস্কৃত। তার পর হিন্দি আর উর্দু।’
সুইডেনের ইসাবেলা এক বছরের কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। পেশায় আইনজীবী, উর্দু শিখতে চান। “লাহোরে গিয়ে শিখব ভেবেছিলাম। সবাই পাকিস্তান যেতে বারণ করল।”
উর্দু কেন? “জানেন না, ইট ইজ ল্যাঙ্গোয়েজ অব লাভ!” হাসলেন ইসাবেলা।
ল্যান্ডোরে আজই আমার শেষ রাত। সন্ধ্যাবেলায় কবরখানায় গিয়েছিলাম। অনেক পুরনো সমাধি। সবচেয়ে পুরনোটা ক্যাপ্টেন জর্জ বোল্টনের। ১৮২৮ সালে ৪০ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। বেশির ভাগ মৃত্যুই তখন চল্লিশের কোঠায়। সাইপ্রেস-এর গায়ে ফলক, ‘১৮৭০ সালে এই বৃক্ষ রোপণ করলেন হিজ রয়াল হাইনেস ডিউক অব এডিনবরা।’ কবরখানা থেকে বেরিয়ে আসছি, আকাশে চাঁদের আলো। আর তখনই চোখে পড়ে গেল তাকে। পাশের জঙ্গলে হাঁটছে। বড়সড় বনবিড়ালের মতো দেখতে, বিশাল রোমশ লেজ, গলার কাছে হলুদ-কমলা। ইয়েলো থ্রোটেড মার্টেন! রাস্কিন বন্ডের গল্পের চিতাবাঘ দেখতে পেলাম না, এটাই বা কম কী!
মার্টেন তো? কে জানে! রাস্কিন বন্ডের ভূতের গল্পে তো এই কবরখানাটা প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.