নিছক কবির আশাবাদ নহে, সত্যই এমন দেশটি আর কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। দেশ বলিতে বঙ্গভূমি। ইউরোপের ত্রিশ জন ভূপর্যটক গাড়ি চালাইয়া পৃথিবী দেখিতে বাহির হইয়াছিলেন। জার্মানি, পোল্যান্ড, লাটভিয়া, রাশিয়া, কাজাখস্তান, চিন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান ঘুরিয়া তাঁহারা উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করেন। অতঃপর, কলিকাতা। বার্লিন হইতে কলিকাতা, মোট ১৬,৮০০ কিলোমিটার রাস্তায় মরুভূমি ছিল, পার্বত্য পথ ছিল। কিন্তু, অভিযাত্রীরা স্বীকার করিয়াছেন, একমাত্র কলিকাতায় আসিয়াই তাঁহাদের নাড়ি ছাড়িয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। শহরের পথে সবাই রাজা, ফলে যাহার যেমন খুশি, চলিতেছে। অভিযাত্রীরা কবুল করিয়াছেন, এই অভিজ্ঞতা তাঁহাদের আর কোথাও হয় নাই। ভবিষ্যতে হইবে, এমন আশঙ্কাও কম।
কলিকাতার গাড়ি চালকদের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁহারা লক্ষ করিয়াছেন যেখানে থামিয়া থাকিলে লাভ, সেইখানেও কলিকাতার চালকরা গাড়ি চালাইয়া দেন। ফলে, দুই মিনিট দাঁড়াইলেই যেখানে চলিত, সেখানে ঘণ্টাব্যাপী ট্র্যাফিক জ্যাম বাঁধিয়া যায়। এই ঘটনাটি দেখিলে কোনও অর্থশাস্ত্রী বলিতেন, এই চালকেরা যুক্তিশীল। তাঁহারা কলিকাতার রাস্তায় প্রতি দিন দ্বন্দ্বতত্ত্বের অতিপরিচিত ‘দ্য প্রিজনার্স ডিলেমা’ গেমটি খেলিতেছেন। খেলাটি এই রূপ: ধরা যাউক, পুলিশ দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করিল, যাহাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। তাহাদের স্বীকারোক্তিই একমাত্র প্রমাণ হইতে পারে। পুলিশ তাহাদের দুইটি পৃথক ঘরে বসাইল, এবং জানাইল যে যদি দুই জনই অপরাধ স্বীকার করে, তবে দুই জনেরই ছয় বৎসরের জেল হইবে। দুই জনই অস্বীকার করিলে অন্য কোনও মামলায় জড়াইয়া এক বৎসর জেলের ব্যবস্থা করা হইবে। কিন্তু, যদি এক জন অপরাধ স্বীকার করে, আর অন্য জন অস্বীকার করে, তবে যে অস্বীকার করিবে, তাহার নয় বৎসরের জেল এবং যে স্বীকার করিবে, সে বেকসুর খালাস পাইবে। খোলা চোখে দেখিলে, অস্বীকার করিলে দুই জনেরই লাভ। কিন্তু, যদি দুই জনই অস্বীকার করে, তখনই। দ্বন্দ্বতত্ত্বের সাহায্যে খুব সহজে দেখানো যায়, দুই জনই অপরাধ কবুল করিয়া ছয় বৎসরের জন্য জেলে যাইবে। ইহাই যুক্তিসঙ্গত আচরণ।
কলিকাতার রাস্তাতেও এই খেলাই চলিতেছে। প্রতিটি চালক জানেন, খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করিলে সকলেরই লাভ। কিন্তু, যদি অন্য চালকরাও অপেক্ষা করেন, তখনই। যদি আর সকলে অপেক্ষা করে, এবং মাত্র এক জন আগাইয়া যান, তবে তাঁহার লাভ। ঠিক যেমন, এক জন অপরাধ কবুল না করিলে অন্য জনের অপরাধ কবুল করায় লাভ। এই লাভের কথাটি যেহেতু প্রত্যেক গাড়িচালকই জানেন, ফলে প্রত্যেকেই এই লাভটি করিতে চাহিবেন। অন্য ভাবে দেখিলে, আর সকলে আগাইয়া গেলে যিনি নিয়ম মানিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবেন, তাঁহার ক্ষতি, কারণ জ্যামে তিনি সকলের পিছনে পড়িয়া যাইবেন। এই লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলি যেহেতু সর্ব-চালক-জ্ঞাত, এবং তাঁহারা যেহেতু যুক্তিশীল, ফলে প্রত্যেকেই আগাইয়া যাইতে চাহেন। ফল, প্রত্যেকেরই ক্ষতি। এই চক্র ভাঙিতে হইলে যুক্তির পথে হাঁটা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। |