মাত্র ১০ হাজারে নাইন এমএম পিস্তল। একে ৪৭-এর দাম মেরেকেটে ৩০ হাজার। আর ২৫ হাজারেই মিলছে কার্বাইন। দুষ্কৃতীদের ‘খোলাবাজারে’ এই দামেই বিকোচ্ছে এমন সব ‘দেশি’ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
আঁতুড়ঘর বিহারের সেই মুঙ্গের।
চোরাকারবারীদের ‘চেনা পথ’ ধরে ওই সব অস্ত্র ঢুকছে এ রাজ্যেও। আসানসোল থেকে শিলিগুড়ি, গত পাঁচ মাসে পুলিশ যত বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার কিংবা আটক করেছে, তার একটা বড় অংশই মুঙ্গেরে তৈরি। সেখানকার এই ‘কুটির শিল্প’ই ঘুম কেড়েছে এ রাজ্যের পুলিশের।
ক্ষমতায় আসার পরেই বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই কাজ দেখভালের জন্য তাঁর নির্দেশে দু’টি কমিটিও তৈরি করেছে রাজ্য পুলিশ। সেই কমিটির একটি দক্ষিণবঙ্গে, আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনারকে মাথায় রেখে। অন্যটি উত্তরবঙ্গে, ডিআইজি (জলপাইগুড়ি)-র নেতৃত্বে। কমিটিতে জেলা পুলিশ ছাড়াও রেল পুলিশ সুপারদের রাখা হয়েছে।
আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ বলেন, “জামুড়িয়া থেকে যত অস্ত্র আটক করা হয়েছে, তার মধ্যে কার্বাইনও রয়েছে।” পুলিশের দাবি, সেই সূত্র ধরে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারাই জানিয়েছে মুঙ্গের থেকে একেকটি কার্বাইন তারা ২৫ হাজার টাকায় কিনেছে। নাইন এমএম পিস্তল কিনেছে ১০ হাজারে। পুলিশের এক কর্তা জানান, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বাজারে বিক্রি হয় না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নথিভূক্ত সংস্থা থেকেই রাজ্য পুলিশ তা কেনে। বর্তমানে নাইন এমএমের দাম প্রায় ১ লক্ষ টাকা, দেড় লক্ষের কমে মেলে না কার্বাইন অথবা একে ৪৭-র মতো রাইফেল।
পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, দামে সস্তা হলেও মুঙ্গেরে তৈরি অস্ত্রের মারণক্ষমতা সরকারি কারখানায় তৈরি আসল অস্ত্রের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, কার্তুজে বারুদের পরিমাণ ও গুলির গতির উপরে নির্ভর করে আগ্নেয়াস্ত্রের শক্তি। ওই অস্ত্র থেকে ৪০ গজ দূরেও কাউকে গুলি করলে তার মৃত্যু নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া হয়। মুঙ্গেরে অস্ত্র এমন ভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে আসল কার্তুজ ব্যবহার করা যায়। এর ফলে অস্ত্র দেশি হলেও সেগুলির মারণক্ষমতা কোনও অংশে কম নয়।
জানা গিয়েছে, মুঙ্গের থেকে গঙ্গা পেরিয়ে অস্ত্র আসছে ভাগলপুর ও সাহেবগঞ্জ হয়ে গিরিডিতে। সেখান থেকে রেলপথে টুন্ডি হয়ে ধানবাদ। ধানবাদে পৌঁছে গেলে আসানসোল কার্যত নাকের ডগায়। আর উত্তরবঙ্গে অস্ত্র পৌঁছয় ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে বীরভূম ও মালদহ হয়ে। এক পুলিশকর্তা বলেন, রেলপথে মূলত মহিলাদের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট এলাকায় অস্ত্র পৌঁছে দিচ্ছে চোরাকারবারীরা। তাদের কয়েক জনের ‘স্কেচ’ আঁকানো হয়েছে। তবে এখনও কাউকে ধরা যায়নি।
কিন্তু কারা বানাচ্ছে ওই মারণাস্ত্র?
মুঙ্গেরে গঙ্গার চরে বসবাসকারী একটি সম্প্রদায়ই মূলত অস্ত্র বানায়। বিহার পুলিশের একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, বংশ পরম্পরায় ওই কাজ করে তারা এতটাই দক্ষ হয়েছে, যে অস্ত্রই বাজারে আসুক না কেন, তারা সেটা জোগাড় করে তার যন্ত্রাংশ খুলে দেখে নিয়ে পরে লেদ মেশিনে নকল যন্ত্র তৈরি করে নেয়। তার পরে সেটা পুঁতে রাখে চরের বালিতে।
তাদের ধরা যায় না কেন? বিহার প্রশাসনের একাধিক কর্তার সাফাই, গাড়ি নিয়ে ওখানে পৌঁছনো যায় না। অস্ত্র কারখানায় যেতে নদীর চর ধরে তিন-চার কিলোমিটার হাঁটতে হয়। ধূ ধূ প্রান্তরে পুলিশ ঢুকতে দেখলেই পালিয়ে যায় অস্ত্র নির্মাতারা। শুধুই কী তাই? পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, গঙ্গার চরে অস্ত্র তৈরি এক সময় ‘কুটির শিল্প’ থাকলেও এখন ‘বৃহৎ শিল্প’ হয়ে গিয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দল ওই ‘ব্যবসা’য় লগ্নিও করছে।
জলপাইগুড়ির কালচিনিতেও মিলেছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দেশি সংস্করণ। উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি ডাকাতির তদন্তে নেমে রাজেশ মিশ্র নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার সাগরেদদের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ২৫টি দেশি নাইন এমএম, দু’টি একে ৪৭ এবং একটি কার্বাইন। বিহারের বাসিন্দা রাজেশ জেরায় জানিয়েছে, মুঙ্গের থেকে অস্ত্র কিনে সে অসমের একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছেও বিক্রি করেছে। এমনকী, কলকাতাতেও সে অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছে বলে কবুল করেছে রাজেশ। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, “মাওবাদীদের পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মির হাতে আসল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরের সারির লোকজন যে সব অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মুঙ্গের থেকেই সেগুলি জঙ্গলমহলে পৌঁছেছে।” |