মতাদর্শগত দলিল নিয়ে এ কে গোপালন ভবনে যে বৈঠক শুরু হয়েছে, তার মূল প্রতিপাদ্য হল, একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের অভিমুখ কী হবে। সেই বিতর্কে সব থেকে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, চিনে ‘সমাজতন্ত্র’ নামে যে ব্যবস্থা চলছে, সেটাই কি এ দেশেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঠিক উপায়? পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনদের শিল্পায়নের ‘ব্যর্থ’ প্রচেষ্টা ও বাম-দুর্গের পতনের প্রেক্ষাপটে চিন নিয়ে এই বিতর্ক জমে উঠেছে।
চিনে বৃষ্টি হলে তাঁদের ঠান্ডা লাগে, এমন অভিধা অর্জন করেছেন এ দেশের সিপিএম নেতারা। সেই দলেই চিন নিয়ে এই রকম বিতর্ক যে অভূতপূর্ব, তা সিপিএমের নেতারাও মানছেন। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “এই ভাবে চিনের সমাজতন্ত্রের চরিত্র নিয়ে সিপিএমের অন্দরমহলে আগে কখনও আলোচনার দরকার পড়েনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হারের প্রেক্ষাপটে এই আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।’’ কী ভাবে? বিতর্কের এক মেরুতে যদি থাকেন প্রকাশ কারাট, তা হলে বিপরীত মেরুতে অবশ্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর শিল্পনীতি। দলের মধ্যে ‘কট্টরপন্থী’ বলে পরিচিতরা মনে করছেন, চিনে যে ভাবে বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিল্পায়ন হচ্ছে, তা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ হতে পারে না। কিন্তু চিনের সেই মডেলকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেববাবুরা। বড় বড় পুঁজিপতিদের রাজ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ডাক দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। তার জন্য সরকারের তরফে শিল্পপতিদের বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়।
এই মডেলের বিরুদ্ধে যুক্তি হল, পুঁজিপতিদের সঙ্গে এই ভাবে জোট বাঁধতে গিয়ে চিনের পার্টি শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে ধীরে ধীরে ‘পুঁজিপতিদের দলে’ পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার নেই। কারাট-শিবিরের যুক্তি, চিনে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনটুকুরও নিশ্চয়তা নেই। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে চিনের অর্থনীতি আসলে এমন একটা আগ্রাসী পুঁজিবাদী অর্থনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণটা শুধু বাজারের হাতে থাকার বদলে রয়েছে রাষ্ট্রের হাতে। পশ্চিমবঙ্গেও টাটা-জিন্দল-সালিমদের সঙ্গে বুদ্ধদেব-নিরুপমের দহরম-মহরম দেখে একই ভাবে মানুষের কাছে ‘ভুল বার্তা’ গিয়েছিল যে ‘গরিব মানুষের পার্টি’ সিপিএম এখন ‘বড়লোকদের পার্টি’ হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া চিনে যে ভাবে গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ করে বা শ্রমিকদের উপর জোর খাটিয়ে বিরাট আকারের শিল্পায়ন সম্ভব হচ্ছে, তা এ দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রে সম্ভব নয়। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের মতো প্রতিরোধ যে বার বার হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
চিনের মডেলের পক্ষে যাঁরা, তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, তা হলে কি শিল্পায়নের চেষ্টাই করা হবে না? যে অচলাবস্থা রয়েছে, তা-ই বজায় থাকবে? মানবাধিকারের অভিযোগ থাকলেও চিনে যে উন্নতি হয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বদল এসেছে, তাতে তো সন্দেহ নেই। পাল্টা যুক্তি হল, প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও শিল্পায়নের প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু দলের মূল জনসমর্থনের ভিত্তি যে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণি, তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই শিল্পায়নের কথা বলেছিলেন তিনি। প্রথমেই ন্যানো বা পেট্রো-রসায়ন শিল্পতালুক তৈরির চেষ্টায় না গিয়ে রাজ্যেই যে সব কাঁচামাল সহজলভ্য ছিল, তা ব্যবহার করে শিল্পায়নের চেষ্টা করা উচিত ছিল। এতে শিল্পায়নও হত, সাধারণ গরিব মানুষের সমর্থনও অটুট থাকত।
গত কাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হওয়ার পর পলিটব্যুরোর তরফে সীতারাম ইয়েচুরি মতাদর্শগত দলিলের খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বৈঠকে নেই। কিন্তু মতাদর্শগত দলিল নিয়ে তিনি আগেই ইয়েচুরিকে ‘লিখিত নোট’ পাঠিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিয়েছেন গৌতম দেব। তাঁর উপস্থিতি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ চিনের এই মডেলের পক্ষে বরাবর সওয়াল করে এসেছেন গৌতমবাবু। বিজয়ওয়াড়ার বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে সকলের সায় নিতে হবে।
বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে গৌতম দেব দলের নথি খারিজ করে দিয়ে বলেছিলেন, “বইয়ে যাই লেখা থাক, সকলের সায় নিতে গেলে জমি অধিগ্রহণ করাই যাবে না।”
এর আগে ১৯৬৮ সালে পার্টির মতাদর্শগত দলিল নিয়ে আলোচনার সময়ে প্রশ্ন ছিল, সোভিয়েত না চিন, কার অনুকরণ করবে ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি? বলা হয়েছিল, অন্ধ ভাবে কারও অনুকরণ না করে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নতুন পথ খোঁজা হবে। এ বার কোন অভিমুখে হাঁটবে দল? আগামী পার্টি কংগ্রেসের আগে সিপিএম এই বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান নেয়, না কি বিতর্ক অমীমাংসিত বলে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে, সেটাই এখন দেখার। |