রাজ্য সরকার গণবণ্টন ব্যবস্থার উন্নতিতে জোর দিয়েছে। তার উপরে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু পুরুলিয়া জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতর পরিকাঠামোর অভাবে ‘ধুঁকছে’। সেই রোগ না সারালে সরকারি উদ্যোগ কতখানি সফল হবে-তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চিত্র ১: রেশন দোকান থেকে উপভোক্তাদের সঠিক পরিমাণে মাল দেওয়া হচ্ছে কিনা তা দেখার কথা খাদ্য দফতরের পরিদর্শক ও সহকারী পরিদর্শকের। শুধু তাই নয়, ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার গুদাম থেকে পরিবেশকরা মাল তোলার সময় সেখানেও পরিদর্শকদের হাজির থাকার কথা। দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বও তাঁদের দেওয়া হয়। কিন্তু পরিদর্শক ও সহকারী পরিদর্শকের বহু শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। ফলে পরিদর্শন কেমন হচ্ছে তা নিয়ে খোদ দফতরের কর্তারাই সংশয়ে রয়েছেন। একই কারণে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের জন্য ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার বিশেষ কার্ড তৈরির কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
চিত্র ২: জেলাশাসকের কার্যালয়ের তিন তলায় জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতর। আর পুরুলিয়া মহকুমা খাদ্য নিয়ামকের দফতর সেখান থেকে কয়েকশো মিটার দূরে পুলিশ সুপারের অফিসের পাশে। ফলে দুই দফতরের মধ্যে সমন্বয় রাখার কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে বলে কর্মীরা জানিয়েছেন। এক আধিকারিক বলেন, “দুই দফতর একই ছাদের তলায় নিয়ে আসার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কাজ হয়নি।”
চিত্র ৩: ঝালদা ২ ব্লকের ডুড়কু গ্রামের কয়েকশো বাসিন্দা কয়েক দিন আগে পুরুলিয়া-রাঁচি রাস্তা অবরোধ করেছিলেন। অভিযোগ, আবেদন করার পরেও ২ টাকা কেজি দরের চাল বা তার কার্ড পাননি। অবরোধকারীদের দাবি, খাদ্য দফতরের কর্তাদের সেখানে গিয়ে কেনও তাঁরা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, তা জানাতে হবে। সেখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া শহরে জেলা ও মহকুমা খাদ্য নিয়ামকের দফতর। দফতরের একটিও গাড়ি নেই। শুধুমাত্র জেলা খাদ্য নিয়ামকের জন্য ভাড়ায় একটি গাড়ি রয়েছে। খাদ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “যারা অবরোধ করেছিলেন, তাঁদের কার্ড তৈরি করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই তাঁরা কার্ড পেয়ে যাবেন। কিন্তু গাড়ি না থাকায় আমরা তাঁদের কাছে গিয়ে তা জানাতে পারিনি। আমাদের সমস্যার কথা জেনে ঝালদা ২ ব্লকের বিডিও অনুপকুমার দাস গিয়ে অবরোধকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে অবরোধ তোলেন।
জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জঙ্গলমহলের ৮টি ব্লকের বাসিন্দাদের প্রায় দেড় লক্ষ বিশেষ কার্ড বিলি করা হয়েছে। আরও প্রায় তিন লক্ষ কার্ড দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু তাতে বাধ সেধেছে কর্মীর অপ্রতুলতা। প্রতি কার্ডে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শককে চারটি করে সই করতে হচ্ছে। জেলা খাদ্য নিয়ামক সুনয়কুমার গোস্বামী বলেন, “কার্ডে সই করা ও খাতায় উপভোক্তাদের নাম লেখার মত কর্মীর অভাব রয়েছে। ফলে বিধি মোতাবেক নথিপত্রের কাজ চুকিয়ে কার্ড বিলি করতে বেশ সময় লাগছে।”
দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্লক প্রতি এক জন পরিদর্শক ও অন্তত দু’টি গ্রামপঞ্চায়েত প্রতি একজন করে সহকারী পরিদর্শকের প্রয়োজন। সেই হিসেবে প্রতি ব্লকে এক জন পরিদর্শক ও নূন্যতম পাঁচ জন সহকারী পরিদর্শক থাকার কথা। পুরুলিয়া জেলার ২০টি ব্লক ও তিনটি পুর এলাকার জন্য পরিদর্শক ও সহকারী পরিদর্শক মিলিয়ে প্রায় ১২৯ জনের থাকার কথা। ধান মজুত করে রাখা গুদামেও পরিদর্শকদের থাকার কথা। এ ছাড়া জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতরেও কয়েক জন পরিদর্শকের প্রয়োজন। কিন্তু, বাস্তবে তার অনেক কম কর্মী রয়েছেন। বর্তমানে জেলায় মাত্র ১০ জন পরিদর্শক রয়েছেন। সহকারী পরিদর্শকের সংখ্যা ১৭ জন। জেলা খাদ্য নিয়ামক সুনয়কুমার গোস্বামী বলেন, ‘‘৬১ জন পরিদর্শক ও ৫০ জন সহকারি পরিদর্শক প্রয়োজন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
এই পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, ঢাল-তলোয়ারহীন অবস্থায় খাদ্য দফতরের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর কীভাবে এই পিছিয়ে পড়া জেলার গণ-বন্টন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারবে? জেলা খাদ্য নিয়ামকের স্বীকারোক্তি, “জেলা সদরেও পরিদর্শক নেই। অভিযোগ এলে আমিই তদন্ত করতে বেরোই।” পুরুলিয়া জেলা সফরে এসে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছিলেন, চুরি ও পাচার রুখতে প্রশাসনকেও অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু, এই পরিকাঠামোয় তা কতটা সম্ভব? খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “পুরুলিয়ার দুর্বল পরিকাঠামোর কথা জানি। পৃথক একটি খাদ্যভবন গড়া ও পরিকাঠামোর উন্নতি কীভাবে করা যায়, তা দেখা হচ্ছে।” |