চিত্র-১: দমকল দফতরের ফোনটা বেজে উঠল রাত ঠিক দেড়টা নাগাদ। নাইট ডিউটিতে থাকা এক দমকল কর্মী দ্রুত ক্রেডল থেকে রিসিভারটা তুলেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নমস্কার জানাতেই ভেসে এল, “করিমপুর ফায়ার স্টেশন? আপনারা তো আগুন নেভান পারেন, আমার হৃদয়ের আগুন নেভাতে পারবেন?” মহিলার এ প্রশ্নের স্বাভাবিক কোনও উত্তর দিতে পারেননি সেই কর্মী। ফোনটা কেটে যায়।
এক-আধ বার নয়, এমন ফোনে করিমপুর কিংবা কৃষ্ণনগর ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা এখন অভ্যস্ত।
চিত্র ২: ফোন তুলতেই রাতের-কর্মীটি জানতে পেরেছিলেন, “বড়সড় আগুন। বাড়ি জ্বলছে। আমাদের বাঁচান।” ঠিকানা জেনে সেই পাড়ায় ছুটে গিয়ে দমকল কর্মীরা দেখেছিলেন, দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন শুধু ওই পাড়া নয়, ওই এলাকায় বিগত দশ বছরে কোনও আগ্নিকাণ্ডের খবর নেই। পুলিশের কাছে এমন গুজব ছড়ানো ফোনের ব্যাপারে বার বার অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি। অতএব, এমন ‘পালে বাঘ পড়ার’ গল্পের মতো ফোন আসছেই। কর্মীরা ছুটেও যাচ্ছেন। দমকলের এক কর্তার কথায়, “কী করব বলুন, না গিয়ে তো উপায় নেই!” |
কখনও মিথ্যে-আগুন কখনও বা ‘হৃদয়ে’নদিয়ার অদিকাংশ দমকল স্টেশনে এই উড়ো ফোনের জ্বালায় জেরবার। দমকলের মত জরুরী একটি পরিষেবা নিয়ে এরকম ছিনিমিনি ক্রমেই বাড়ছে। দমকল দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে এমন ফোনের পরিসংখ্যানও রয়েছে। করিমপুরে গত মাসে এমন ফোনের সংখ্যা ৪০। নবদ্বীপে এসেছে ৪৯৯। আর কৃষ্ণনগরে শ-পাঁচেকেরও বেশি। নদিয়ার প্রায় সবকটি দমকলেই কমবেশি এই ধরণের ফোন আসে বলে অভিযোগ।
করিমপুর দমকলের ওসি সুখেন সরকার বলেন, ‘‘সত্যি কথা বলতে এই ধরণের ফোনের অত্যাচারে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন সত্যি সত্যিই কোথাও আগুন লাগলে আমাদের নিশ্চিত হয়ে তবেই বেরোতে হচ্ছে। ফলে অনেক সময়ে যেতে যে একটু দেরিও হচ্ছে। প্রথমে যে লম্বর থেকে পোন আসছে সেকানে পোন করে যাচাই করে নিতে হচ্ছে যে এমন ফোন করা হয়েছিল কিনা। তারপরে স্থানীয় থানায় পোন করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এলাকার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েতে ফোন করা হচ্ছে। আদৌ এমন কোনও পোন করা হয়েছে কিনা, জানা হচ্ছে। ফলে আমাদের মতোই সাধারন মানুষও হয়রান হচ্ছেন।’’
কৃষ্ণনগর দমকলের ওসি হরলাল সরকার জানান,‘‘ সারা দিনে রাতে এরকম অজস্র ফোন আসে জেলার সব দমকলগুলিতে এই একই সমস্যা আছে কেউ কেউ আবার ফোন করে কোন কথা বলে না শুধু তার নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায় রাত দুপুরে দমকলে ফোন করে এরকম রসিকতা কার ভালো লাগে বলুন?’’
নবদ্বীপ দমকলের ওসি শক্তিরঞ্জন দে’র অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম তিনি বলেন,‘‘এই ধরণের ফোন বেশি আসে রাত বারোটার পরে দমকলে প্রায়ই গভীর রাতে একটি মেয়ে অকারণে ফোন করত একবার বিরক্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন এরকম বার বার বিরক্ত করেন? মেয়েটি জানিয়েছিল তার নাকি রাতে ঘুম আসে না তাই কারো সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে এতরাতে দমকলেই যেহেতু লোকজন থাকে তাই সে ফোন করে ভাবুন একবার! এছাড়াও অনেক সময় আমরা অপ্রয়োজনীয় ফোন বুঝতে পেরে লাইন কেটে দিই কিন্তু ওদিকে ফোনটা তখন হয়ত ধরেই আছে এরকম অবস্থায় লাইনটা কিন্তু ব্যস্তই থেকে যায় জরুরী ফোন করে তখন অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না আমরা পুলিশকে এরকম বহুবার অভিযোগ জানিয়েছে কিন্তু তেমন কোন ফল পাওয়া যায়নি’’
কেন এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ? শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের মনোবিদ দেবাশিস দাশগুপ্তের ব্যাখ্যা,‘‘এটা এক ধরণের মানসিক বিকৃতি। এরা দমকল, পুলিশ বা অ্যাম্বুল্যান্সের মত জরুরী বিভাগে অকারণে ফোন করে বিরক্ত করে মজা পান। ’’
তেহট্টের এসডিপিও মলয় মজুমদার বলেন,‘‘ মানুষ বিনা পয়সায় ফোন করে যাতে জরুরী পরিষেবা পায় সেজন্য সরকার এরকম টোল ফ্রি ফোন পরিষেবা চালু করেছিল কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সুবিধার অপব্যবহার করছেন কিছু মানুষ যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে। পুলিশের কাছেও এরকম অজস্র ফোন আসে।” আসলে এটা সচেতনতার প্রশ্ন। মানু,রে মধ্যে তা না ফিরলে বাস্তবিকই যে এক দিন ‘হৃদয়’ পুড়বে তা কে বোঝাবে!
|