ধ্যাড়ধ্যাড়ে সাইকেলে টোল খাওয়া মাইক। নাইলনের দড়িতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কার্তিকের আচমকা চড়া রোদ্দুরে একটু ছায়া খুঁজে সেই মাইক বলছে‘‘শুনত্যাছেন গো আপনারা, একটি বিশেষ ঘোষণা। গায়ের রং শ্যামলা, পরনে হলুদ শাড়ি। কথা ব্যুইলতে পারে না। শুনেও না। বারো দিন হল হারাই গিইসে আমার বিটিটা। আপনারা দ্যাখলে জানাবেন গো!”
|
পুলিশ-প্রশাসনের দরজায় ধাক্কা খেয়ে আটপৌরে দিনমজুর শামসুল মণ্ডল তাঁর হারানো মূক-বধির মেয়েটার জন্য নিজের সাইকেলেই বেঁধে নিয়েছেন মাইক। রানিনগর বাজার থেকে ভাড়া নিয়েছে একশো টাকা। শামশুল বলেন, “কাজে আর বেরুতে পারছি কই, পাড়াপড়শি পাশে না দাঁড়াইলে মাইক ভাড়ার টাকাটাও উঠত না।” খবরের কাগজে জড়ানো গোটা কয়েক রুটি আর আলুভাজা, শামসুল খুঁজে চলেছেন মেয়েকে। গত চৈত্রে আটাসে পড়া মানোয়ারার কথা বলতে গিয়ে ভিজে আসে বাবার চোখ, ‘‘মেয়েটা কথা বলতে পারে না তো কী হয়েছে? বড় লক্ষ্মী মেয়ে গো। সেই রবিবার সকাল দশটায় জ্বরের ওষুধ নিতে হাসপাতালে গিয়েছিল। আর ফিরল না।” বাড়ির লোক প্রথমে ভেবেছিলেন কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়েছে বুঝি। কিন্তু দু’দিন না ফেরায় ভাঁজ পড়েছে কপালে। আশপাশের গাঁ-গঞ্জে পরিজনদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েও যখন মানোয়ারার খোঁজ মিলল না তখন পুলিশের কাছে ছুটেছিলেন শামশুল। তিনি বলেন, “পুলিশ ডায়েরি নিয়ে বলল, নিজেই খোঁজ করুন। কাউকে সন্দেহ হলে বা খোঁজ পেলে আমাদের জানাবেন।” গত ৩০ অক্টোবর থেকে তাই মেয়ের খোঁজে নেমেছেন। ভাঙা সাইকেলে বাঁধা মাইক-মাইক্রোফোন হাতে বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ় অনভ্যস্ত গলায় দুপুরভর গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে খুঁজে চলেছেন মেয়েকে। শীতের দুপুরে অনভিজ্ঞ গলার প্রচারটা শুনেই এগিয়ে আসছেন অনেকে। মাঝে মাঝে ঘামে ভেজা জামার বুক পকেট থেকে একটা অস্পষ্ট ছবি বের করে দেখাচ্ছেন জড়ো হওয়া জনতাকে। তারপর সাইকেল ছোটাচ্ছেন অন্য গ্রামে।
|
এলাকার বিধায়ক কংগ্রেসের ফিরোজা বেগম অবশ্য দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘আমি লজ্জিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে খবরটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল। আমি এখনই ওই মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করছি। পঞ্চায়েত ও প্রশাসনকেও অনুরোধ করব শামসুলের পরিবারের পাশে থাকার জন্য।’’ শৈবালবাবু বলেন,‘‘আমাদের এলাকায় অনেক এনজিও পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের উদ্ধারের কাজ করে। তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলব।’’ আর জেলার পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলেন,‘‘রানিনগরের ওসির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলব।’’
সে ভরসায় কী আর বুক বাঁধতে পারেন বাবা, কার্তিকের দুপুরে শামশুল তাই গ্রামের পথ ধরেন, “শুনছেন গো, একটা বিশেষ ঘোষণ....।”
|