|
|
|
|
তৃণমূলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে উত্তপ্ত আরামবাগ মহকুমার বহু এলাকা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • আরামবাগ |
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং তার জেরে অশান্তি অব্যাহত আরামবাগ মহকুমায়।
এক সিপিএম কর্মীর জমির ধান কাটাকে কেন্দ্র করে তৃণমূূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে বৃহস্পতিবার সকালে তেতে ওঠে আরামবাগের চকানল গ্রাম। দু’পক্ষই লাঠি-রড-শাবল নিয়ে পরস্পরের উপরে চড়াও হয়। আহত হন ১৫ জন। গুরুতর জখম ৯ জনকে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে ৪ জনকে স্থানান্তরিত করানো হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে গোলমাল হয় গোঘাট এবং খানাকুলেও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, চকানল গ্রামের বাসিন্দা অসিত খাঁ নামে সিপিএমের ওই সক্রিয় কর্মী বেশ কিছু জায়গা-জমির মালিক। মাস দুয়েক আগে গ্রামের রাস্তার ধারে তৃণমূল একটি দলীয় কার্যালয় করতে বেড়া দেয়। অভিযোগ, সেই বেড়ার মধ্যে অসিতবাবুর জমির অনেকটাই চলে যায়। অসিতবাবু বাধা দিলেও কাজ হয়নি। মাটির ঘর নির্মাণ হতে থাকে। অসিতবাবু আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরার দ্বারস্থ হন। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। তৃণমূল দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করলেও তা ব্যবহার হয়নি। গত ২১ অক্টোবর পুলিশে দায়ের করা অভিযোগে অসিতবাবু জানান, স্থানীয় তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষ ও তাঁর অনুগামীরা তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন। অভিযোগ তোলার জন্য চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি ধান কাটা যাবে না বলে ওই তৃণমূল নেতা ফতোয়া জারি করেছিলেন বলে দাবি অসিতবাবুর।
সেই চাপ এবং ফতোয়া অগ্রাহ্য করে বৃহস্পতিবার জমির ধান কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন অসিতবাবু। এ জন্য বাইরে থেকে শ্রমিকও নিয়ে আসেন। তা থেকেই গোলমাল বাধে। অভিযোগ, শ্রমিকদের চড়-থাপ্পড় মেরে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন অশোকবাবু ও তাঁর অনুগামীরা। তখনই অশোকবাবুর বিরোধী গোষ্ঠীর তৃণমূল নেতা গৌতম ঘোষ ও তাঁর অনুগামীরা সেখানে উপস্থিত হন। এর পরেই তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ বেধে যায়। দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন থানায়।
এ দিন যে গোলমাল হতে পারে, সেই আশঙ্কাতে সকালেই থানায় চলে আসেন অসিতবাবু। তিনি বলেন, “তৃণমূলের অশোক ঘোষ এবং তাঁর দলবল অভিযোগ তোলার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ওদের বলেছিলাম, অবৈধ নির্মাণ ভেঙে দিতে। কিন্তু ওরা বলেছিল পার্টি অফিস থাকবে। আমাকে হুমকি দিচ্ছিল। কান না দেওয়ায় চার দিন আগে ধান কাটতে দেওয়া হবে না বলে ওঁরা ফতোয়া জারি করেন।”
দলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের প্রসঙ্গে আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা বলেন, “সিপিএমের সুযোগ-সন্ধানী লোকেরা তৃণমূলে চলে এসে নানা ভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। ফতোয়া জারির মতো কোনও অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। অন্যায়কারীরা নতুন বা পুরনো দলের যেমন কর্মী-সমর্থকই হোন, পুলিশকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” জমি দখল হয়ে যাওয়ায় অসিতবাবু যে তাঁর কাছে এসেছিলেন, সে কথা স্বীকার করে নিয়ে বিধায়ক বলেন, “দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ওই কার্যালয় নির্মাণ করতে বারণ করেছিলাম। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কথাও জানিয়েছিলাম। ওরা কান দেয়নি।”
এসডিপিও (আরামবাগ) আকাশ মাগারিয়া জানান, অসিতবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছিলই। এ দিন নতুন করে গণ্ডগোলে দু’পক্ষ অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। অভিযুক্তেরা পলাতক।
ধান কাটা নিয়ে ফতোয়া জারির কথা মেনে নিয়ে তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষ বলেন, “পঞ্চায়েতের নানা কাজে মাথা গলাতেন অসিতবাবু। নানা দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন। সেই সব দুর্নীতির হিসাব চেয়েছিলাম আমরা। ফতোয়া জারি করে তাঁকে চাপে রাখতে চেয়েছিলাম।” অশোকবাবুর দাবি, “ধান কাটা বন্ধ করতে যাইনি। আলোচনার জন্য যেতেই মারধর শুরু করল গৌতমের লোকজন। ওরা সবাই সিপিএমের লোক। নিজেদের তৃণমূল বলে মিথ্যা দাবি করেছে।”
পাল্টা গৌতমবাবু বলেন, “দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই ওরা ধান কাটা নিয়ে ফতোয়া জারি করে। অন্যের জায়গা দখল করে দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। ওরা শ্রমিকদের বাধা দেওয়ায় আমরা এবং গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ করি।’’
চকানলে এ দিন যখন ওই গোলমাল হচ্ছে, তখন তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয় গোঘাটের শ্যাওড়া এবং খানাকুলের ধরমপোতা ও নবাসন গ্রামেও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্যাওড়া গ্রামে তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী রয়েছে। একটি গোষ্ঠীর নেতা সাহেব পাল। অন্যটির নেতা তাঁর কাকা কাল্টু পাল। এলাকা দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চলছিল বেশ কিছু দিন ধরে। বিধানসভা ভোটের আগে কাকা-ভাইপো সিপিএম কর্মী ছিলেন। তখনও দু’জনে দলের দুই গোষ্ঠীতে ছিলেন। গত বুধবার কাল্টু পাল ও তাঁর অনুগামীরা সাহেবের দলবলের উপরে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। বৃহস্পতিবার মল্লিকপাড়ায় সাহেবের অনুগামীদের সঙ্গে কাল্টুর দলবলের প্রথমে মারামারি বাধে। পরে গুলি-বোমারও লড়াই হয় বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। মারামারির মধ্যে পড়ে এক বাস কন্ডাক্টর জখম হন। তাঁকে কামারপুকুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। কাল্টু পালের তিন অনুগামীর বাড়ি ভাঙচুর এবং মহিলাদের নিগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ। বিশাল পুলিশ বাহিনী যায়।
তৃণমূলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে খানাকুলের গ্রাম দু’টিতে কয়েকটি বাড়ির অ্যাসবেসটসের চাল ভাঙা হয়। মাস দুয়েক ধরে ওই গ্রাম দু’টির দুই তৃণমূল নেতা লাল্টু মল্লিক এবং ফিরোজ মল্লিকের বিবাদ চলছে। বৃহস্পতিবার তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দুই নেতাই পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলেছেন। বুধবার রাতেও পিলখাঁ গ্রামে এক তৃণমূূল কর্মী প্রহৃত হন।
আরামবাগে এ ভাবে লাগাতার তৃণমূলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষ চললেও, তা মানতে নারাজ দলের তরফে মহকুমার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তথা চুঁচুড়ার বিধায়ক তপন মজুমদার। তিনি বলেন, “দলে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। সিপিএমের লোকজনই কৌশলে আমাদের দলীয় পতাকা নিয়ে গোলমাল পাকাচ্ছে। পুলিশকে বলা হয়েছে, গোলমাল ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।” |
|
|
|
|
|