|
|
|
|
দলিল নিয়ে আলোচনা এ বার দলের বাইরেও |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
দলের মতাদর্শকে ‘সময়োপযোগী’ করতে গিয়ে গোঁড়ামির খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে সিপিএম। উঠছে ‘লৌহ যবনিকা’। সিদ্ধান্ত হয়েছে, মতাদর্শগত দলিল নিয়ে দলে ভিতরে আলোচনা শেষ হওয়ার পর এ বার দলের বাইরের ‘সমমনস্কদের’ মতামতও নেওয়া হবে।
বস্তুত দলকে এই ভাবে উদার করার পক্ষেই সওয়াল করে এসেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি চাইছেন, সিপিএম চিরাচরিত গোঁড়ামি ছেড়ে বেরিয়ে আসুক। দলের সব সময়ের কর্মী, একনিষ্ঠ সমর্থকদের বাইরেও সিপিএমের প্রতি সহানুভূতিশীল বিরাট জনসমাজ রয়েছে। দলের মতাদর্শ, নীতিগত রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় তাঁদেরও জড়িয়ে নেওয়া হোক। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির ‘নিয়মিত অনুপস্থিত’ সদস্যের সেই দাবিই এ বার মেনে নিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট।
মতাদর্শগত দলিল আলোচনা করতে কাল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসছে। তিন দিনের আলোচনায় যে সব সংশোধনী পেশ হবে, তা নিয়ে ফের ডিসেম্বরে পলিটব্যুরোয় আলোচনা হবে। এর পরে জানুয়ারিতে মতাদর্শগত দলিলে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় কমিটি। তার পরেই দলের মধ্যে আলোচনার জন্য ওই দলিল প্রকাশ করে দেওয়া হবে। ঠিক হয়েছে, ওই দলিলে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ও সিপিএমের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের মতামতও নেওয়া হবে। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এলে তা দলিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সমস্ত পরামর্শ গ্রহণের পরে পার্টি কংগ্রেসে ওই দলিল আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হবে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, সব দিক ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত। কারণ সমাজের একটা বড় অংশ সিপিএমের মিটিং-মিছিলে যোগ না দিলেও দলকে সমর্থন করেন। পশ্চিমবঙ্গে এই অংশটি দীর্ঘদিন ধরে বামেদের ভোট দিয়েছেন বলেই দল পর পর সাত বার বিধানসভায় জিতেছে। এ বার তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতেই দল মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলের কাছে তাঁদের কী প্রত্যাশা, সেটাও জানা জরুরি। শুধু বুদ্ধদেববাবু নন, অশোক মিত্রের মতো প্রবীণ বামপন্থীরাও দলকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মতাদর্শগত দলিলে প্রকাশ কারাট যেমন ‘বাজার’ ও ‘ব্যক্তি মালিকানা’-কে স্বীকৃতি দিয়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তেমনই ওই দলিল নিয়ে আলোচনার পরিধিও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বুদ্ধদেবের ক্রমাগত চাপের মুখেই কি নমনীয় হচ্ছেন কট্টরপন্থী হিসাবে পরিচিত কারাট? গোঁড়া অবস্থান ছেড়ে দলে কিছুটা হলেও গণতন্ত্র আনার চেষ্টা করছেন? পলিটব্যুরোর এক দল সদস্য অবশ্য বিষয়টিকে বুদ্ধদেবের দাবির কাছে কারাটের মাথা নোয়ানো হিসাবে মানতে রাজি নন।
তাঁদের বক্তব্য, দলের বাইরের সমমনস্ক ব্যক্তিদের মতামত আগে যে কখনও নেওয়া হয়নি, এমনটা নয়। সেভিয়েতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের আলোচনা করে ১৯৯২ সালে যে দলিল তৈরি হয়েছিল, তাতেও বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির মত নেওয়া হয়েছিল। রোমিলা থাপার, ইন্দ্রকুমার গুজরাল, কে ভি রঘুনাথ রেড্ডিরা দলিলে মতামত জানিয়েছিলেন। পলিটব্যুরোর এক প্রবীণ সদস্য বলেন, “গুজরাল বলেছিলেন, একে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা বলে উল্লেখ না করে সমাজতন্ত্র পরিচালনার ব্যর্থতা বলে ব্যাখ্যা করা উচিত।” তবে এ বার যে ভাবে মতাদর্শগত দলিলকে বৃহত্তর আলোচনার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনটা আগে হয়নি বলে সকলেই মানছেন।
শুধু দলিল নিয়ে বৃহত্তর আলোচনা নয়, দলের মধ্যে আরও বেশি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা যায়, তারও দিগ্নির্দেশও মতাদর্শগত দলিলে দেওয়া থাকছে বলে পলিটব্যুরো সূত্রে বলা হচ্ছে। সিপিএমের কাণ্ডারী হিসেবে প্রকাশ কারাটের চিন্তার বিষয় হল, উদার হওয়ার নামে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মূল শ্রেণি-চরিত্র না বদলে যায়! তাই দলের ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’-র নীতি বদলাতে তিনি কোনও ভাবেই রাজি নন। কিন্তু সেই নীতি বজায় রেখেই দলের মধ্যে আরও কী ভাবে খোলামেলা আবহাওয়া তৈরি করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এ কে জি ভবনের নেতাদের যুক্তি, কমিউনিস্ট পার্টি বলতেই যে ‘লৌহ যবনিকা’-র যে ছবি ফুটে ওঠে, তা যতখানি বাস্তব, তার থেকেও অনেক বেশি ‘অলীক ধারণা’। দল সব সময়েই খোলামেলা আলোচনা ও বিতর্কে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এই ভুল ধারণা ভাঙতে ইতিমধ্যেই দলের নেতারা সক্রিয় হয়েছেন। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অনেকেই টুইটার-ফেসবুকে যোগ দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা কোনও একটি বিষয়ে বিতর্ক উসকে দিচ্ছেন বা বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু ফেসবুকের ওয়াল-এ আদর্শগত কোনও বিষয়ে বা তাত্ত্বিক আলোচনায় তেমন সাড়া মিলছে না। আলোচনার বৃত্ত বাড়াতে গিয়ে তাই সময়োপযোগী মতাদর্শগত দলিলের প্রাসঙ্গিকতাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হওয়ার আগের দিন, আজ দিল্লিতে ডিওয়াইএফ-র নতুন ভবনের উদ্বোধন করে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন দলের এক মাত্র মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরার মানিক সরকারও। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের যুব সংগঠনের মধ্যে মতাদর্শগত চেতনা আরও বাড়াতে হবে।” |
|
|
|
|
|