|
|
|
|
কট্টরপন্থী কারাট নরম |
মতাদর্শে স্বীকৃতি বাজার ও ব্যক্তি মালিকানাকে |
প্রসূন আচার্য • কলকাতা |
এ বার ‘পরিবর্তন’ সিপিএমে!
একদা এ রাজ্যে শিল্প আনতে গিয়ে পুঁজির রং দেখতে চাননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চিনের উদাহরণ ছিল তাঁর সামনে। বুদ্ধবাবুর যুক্তি ছিল পুঁজি এলে বাজার সৃষ্টি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান।
সদলবলে ভোটযুদ্ধে পরাজিত বুদ্ধবাবু। কিন্তু লাগাতার তাঁদের ‘চাপ’ কট্টরপন্থী প্রকাশ কারাটকেও টলিয়ে দিয়েছে। তাঁর পুরনো অবস্থান ছেড়ে কারাটকে এখন বলতে হচ্ছে বাজার এবং ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েই এ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্তত দলের দৈনিক মুখপত্রে তাঁর সাম্প্রতিক নিবন্ধ সেই রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দলের মতাদর্শকে ‘সময়োপযোগী’ করছে সিপিএম। এই শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের অভিমুখ কেমন হবে, তা নিয়ে নভেম্বর বিপ্লব উপলক্ষে দৈনিক মুখপত্রে বলতে গিয়ে ‘বাজার’ এবং ‘ব্যক্তি মালিকানা’ দুটি বিষয়কেই স্বীকৃতি দিয়েছেন কারাট। চিন, ভিয়েতনাম, কিউবার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং ভেনেজুয়েলা, উরুগুয়ে, বলিভিয়া, ব্রাজিলের মতো লাতিন আমেরিকার বামপন্থী শাসিত দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই মতাদর্শকে যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর দিল্লিতে মতাদর্শগত দলিল নিয়ে আলোচনা হবে। তার পরে তার খসড়া পেশ করা হবে আগামী পার্টি কংগ্রেসে। সেখানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী গ্রহণের পরেই দলিল চূড়ান্ত করা হবে। ২০০০ সালে শেষ বার দলের কর্মসূচিকে সময়োপযোগী করেছিল সিপিএম। বাস্তব পরিস্থিতি মাথায় রেখে তারা সশস্ত্র বিপ্লবের ভাবনা পরিত্যাগ করেছে। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাজার ও ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি না দিলে দলের মতাদর্শকে যে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব নয়, তা বুঝতে পেরেই ‘কট্টরপন্থী’ কারাটও এ বার নরম হয়েছেন বলে জানাচ্ছে আলিমুদ্দিনের একাংশ। তবে একই সঙ্গে দলের নেতাদের দাবি, বাজার ও ব্যক্তি মালিকানা মেনে নেওয়া হলেও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে দলের ‘অভিমুখ’ শ্রমিক-কৃষকদের স্বার্থের দিকেই থাকবে।
একাধিক রাজ্য কমিটির সদস্য মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এই ‘পরিবর্তন’। ওই নেতারা মনে করেন, সিপিএমকে ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকতে হলে মতাদর্শগত দলিলে বাজার ও ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি মেনে নিতেই হবে। দেরিতে হলেও কারাট সেটা বুঝেছেন।
সমাজতন্ত্র মানে ‘বাণিজ্যের রাষ্ট্রীয়করণ’ এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে কারাট লিখেছেন, ‘পণ্য উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা থাকলে সমাজতন্ত্রের ধারণা নাকচ হয়ে যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন এবং খুচরো ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। সে পথে না গিয়ে সমাজতান্ত্রিক অধ্যায়ে পণ্য এক্সচেঞ্জ ও বাজার ব্যবস্থার উচিত ভূমিকা গ্রহণ করা। রাষ্ট্রের উচিত এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা।’
বাজার ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশিই ব্যক্তি মালিকানার কথাও মেনে নিয়েছেন কারাট। তিনি লিখেছেন, ‘যা প্রয়োজন তা হল জনগণের মালিকানা। নিছক রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়’। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে শেয়ার হোল্ডিং বা যৌথ মালিকানা থাকা সম্ভব জানিয়ে কারাট বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে উঁচু মাত্রায় কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা ছিল। সেই ধাঁচে না-গিয়ে জনগণের মালিকানার বিভিন্ন ধরন থাকা সম্ভব এবং এই ভাবে সেগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতাও সম্ভব।’
১৯৬৪ সালে তাদের জন্মলগ্ন থেকেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতকে সামনে রেখে সিপিএম তাদের মতাদর্শগত দলিল তৈরি করেছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর আটের দশক এবং নয়ের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত-সহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের পতনের পরে সিপিএম তাদের মতাদর্শ পরিবর্তনের কথা ভাবে। ১৯৯২ সালের পার্টি কংগ্রেসে সোভিয়েত মডেলের দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকে উল্লেখ করে একটি দলিল তৈরি হয়। সেই দলিলে এই মডেলের ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, মতাদর্শকে সময়োপযোগী করে তোলা হবে।
কেন এই পরিবর্তন? কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, “১৯৯২ সালের দলিলেই আমরা বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম। বর্তমানে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা সম্ভব। আবার চিন বা ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশেও ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত।” নীলোৎপলবাবুর দাবি, “বাজার ও ব্যক্তি মালিকানা মেনে নেওয়া হলেও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে দলের অভিমুখ কিন্তু শ্রমিক, কৃষকের স্বার্থের দিকেই থাকবে।”
কারাট স্বীকার করেছেন, সোভিয়েত মডেল অনুযায়ী রাষ্ট্রের হাতে সব মালিকানা থাকার বিষয়টি যে সঠিক ছিল না, এখন তাঁরা তা উপলব্ধি করছেন। পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও তিনি বাজারের গুরুত্বকে মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘পরিকল্পিত অর্থনীতি হল সমাজতন্ত্রের আর একটি মৌলিক নীতি। কিন্তু এই পরিকল্পনার ধরন এমন যেন না হয়, যেখানে সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে এবং বাজারকে পরিত্যাগ করা হয়’। |
|
|
|
|
|