পরিকাঠামো পরে, ডাক্তারই তো গরহাজির |
রাজ্যের হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামোর খামতি কারও অজানা নয়। অনেক আশ্বাসেও পরিকাঠামো যে বিশেষ বদলায় নাতা-ও হাড়ে হাড়ে জানেন আম-আদমি। তারই মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় পালের মতো তরুণ ডাক্তারেরা যে পরিষেবার ক্ষেত্রে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না, সেই অভিজ্ঞতাও রয়েছে সাধারণ মানুষের। এই মৃত্যুঞ্জয়বাবুরা ছিলেন বলেই প্রাণে বেঁচেছে ঝাড়গ্রামের কিশোর চন্দন দাস। গাছ থেকে পড়ে লিভার ছিন্ন-ভিন্ন হওয়া কিশোরের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসাটা মৃত্যঞ্জয়বাবুরা মেদিনীপুর মেডিক্যালে করেছিলেন বলেই প্রাণে বেঁচেছে চন্দন।
কিন্তু প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার!
সেই মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজেই অধিকাংশ ‘সিনিয়র’ ডাক্তারের গরহাজিরা এখন প্রায় রুটিনে পরিণত। চিকিৎসকই যদি না থাকেন, ‘পরিকাঠামোর অভাব’-এর যুক্তি তো শোনাবে অজুহাতের মতো! স্বাস্থ্য-পরিষেবায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ডাক্তার, সেই তাঁরাই যদি ফাঁকির ফাঁদ তৈরি করেনসাধারণ মানুষ কোথায় যাবেন? মেডিক্যালের সিনিয়র ডাক্তারবাবুদের এই নিয়মের তোয়াক্কা না করা মনোভাবে ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে। যে কারণেই অনেক সময়ে ভাঙচুর, ঘেরাওয়ের ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজে। স্বাস্থ্য-চিত্রে পরিবর্তন আনতে জেলার হাসপাতালে চিকিৎসকদের হাজিরা সুনিশ্চিত করাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, একান্তে মানছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কেসেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। |
যে কোনও হাসপাতালেই শিশু-বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে সেই শিশু-বিভাগের প্রধান মৌসুমী নন্দী। অভিযোগ, সপ্তাহে বড়জোর দেড় দিন থাকেন হাসপাতালে। যে দিন কলকাতা থেকে আসেন, সে দিনটা কোনও রকমে কাটিয়ে পর দিন দুপুরেই ফেরার ট্রেন ধরেন! দেড়-দু’দিনের বেশি দেখা মেলে না মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান সলিলকুমার পালেরও। সোমবার মেদিনীপুরে এলে মঙ্গলবার, বড়জোর বুধবার পর্যন্ত থাকেন। তার মধ্যেও আবার অনেক ডাক্তারবাবুরই বেসরকারি নার্সিংহোমে রোগী দেখতে যাওয়ার রোগও রয়েছে ষোলোআনা!
বিভাগীয় প্রধানদের যদি এই হাল হয়অন্যরাও পেয়ে যান মওকা। ডাক্তারবাবুদের নিয়ম-বহির্ভূত দেদার ছুটির ফাঁদে প্রাণ যায় রোগীর। অথচ, সরকারি নিয়মে চিকিৎসকদের সপ্তাহে ৬ দিন থাকার কথা হাসপাতালেই। কিন্তু মেদিনীপুর মেডিক্যালে এলে মনে হবে, সে নিয়মের বুঝি অস্তিত্বই নেই! হাসপাতাল সুপার রামনারায়ণ মাইতির অসহায় স্বীকারোক্তি, “চিকিৎসকেরা যাতে নিয়মিত আসেন সে জন্য বার বারই বলা হয়েছে। তবু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।”
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, এমনকী রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও), যাঁর কি না সব সময়ে হাসপাতালেই থাকার কথা, প্রয়োজনের সময়ে তাঁদের অনেকেরই দেখা মেলে না। এখন হাউসস্টাফরাও অনেকে সিনিয়রজের অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছেন। স্যার নেই তো হাউসস্টাফও নেই! ভোগান্তি বাড়ছে রোগী ও তাঁর পরিজনেদের। এই ফাঁকির সূত্রেই ‘রেফার’ বাড়ছে। এখানে ভর্তি হওয়া রোগী ডাক্তারের দেখাই পাচ্ছেন না ওয়ার্ডে। অস্ত্রোপচারের দিন পিছোচ্ছে, রোগ-যন্ত্রণাও বাড়ছে।
সমস্যা মানছে চিকিৎসকদের সংগঠনও। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস’-এর সভাপতি আদিত্যপ্রসাদ মণ্ডল বলেন, “এটা ঠিক যে অনেক চিকিৎসক নিয়মিত আসেন না। আমাদের সংগঠনের সদস্যদের নিময়িত আসতে অনুরোধ করেছি। প্রশাসনকেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।” ‘প্রোগ্রেসিভ সার্ভিস ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক কৃপাসিন্ধু গাঁতাইত আবার এ জন্য পূর্বতন বাম সরকারকেই দুষছেন। তাঁর কথায়, “বাম আমলে একটি চিকিৎসক সংগঠন সমান্তরাল প্রশাসন চালাত। আমরা সে পথে চলছি না, চলবও না। প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।” |
চিকিৎসকদের এই ‘ফাঁকি’র বহর দেখে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের ন্যূনতম ৪ দিন হাসপাতালে থাকার নিয়ম চালু করেছিলেন। কিন্তু সেই নিয়মও ভাঙা হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। কর্তৃপক্ষ তখন সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন হাসপাতালে থাকার নিয়ম চালু করেন। কিন্তু তাতেও ‘আপত্তি’ বেশিরভাগ চিকিৎসকের। নিয়মমতো তিন দিনের মধ্যে এক দিন গরহাজির হলেই গোটা সপ্তাহ ‘অ্যাবসেন্ট’ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কখনওই তা করা হয় না বলে অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ সুকুমার মাইতির বক্তব্য, “৬ দিন ‘অ্যাবসেন্ট’ করে দেওয়ার কথা সকলেই জানানোও হয়েছে। তবু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ আসছে। এ বার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে সোমবার দুপুরে এসে মঙ্গলবার কাটিয়ে বুধবার সকালে হাজিরা খাতায় সই করে যাঁরা চলে যান, তাঁদের ‘ফাঁকি’ আটকানো যে রীতিমতো সমস্যার, তা জানেন কর্তৃপক্ষও। সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা।
|