বাড়িতে ফিফা ভিডিও গেম ‘ফিফা ০৯’ বা ‘ফিফা ১১’ রয়েছে? সেখানে অ্যালান গাওকে দেখা যায়। কম্পিউটারে ফুটে ওঠে তাঁর গোল। যুবভারতীতে অ্যালান গাওয়ের বাঁক খাওয়ানো শটে গোলটা যেন সে রকমই কম্পিউটার-সুলভ।
বাড়িতে ইউটিউবে ইনিয়েস্তা-দাভিদ ভিয়ার বোঝাপড়ার গোল দেখার সুযোগ আছে? পেনের সঙ্গে ওয়ান টু খেলে টোলগের গোলটার মধ্যে ফুটে উঠে সেই স্বর্গীয় ঝলক।
স্টেডিয়াম ফেরত লাল-হলুদ জনতা অবশ্য গোল দুটোর তারিফ করার বদলে বিষণ্ণ। টোলগে ওজবে কার্ড দেখে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে নেই। কী দাম রইল ওই অবিশ্বাস্য পাসিং-শুটিং সৌন্দর্যের?
ইস্টবেঙ্গলের ১১ জন দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয়, ভোর ছ’টা নাগাদ হাওড়া আর শিয়ালদহ স্টেশনে যে এত বাঙালি তরুণ ফুটবল কিট নিয়ে নামে, তারা কোথায় যায়?
ছোট দলের কোচেরাবিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, শিশির ঘোষ, শঙ্কর মৈত্র, রঘু নন্দীর সঙ্গে কথা বললে আক্ষেপ ছড়িয়ে পড়ে। হাওড়া-ব্যান্ডেল লাইনে এখন প্লেয়ার কমে এসেছে! কর্তাদের রাজনীতিতে মুছে যাওয়ার পথে হাওড়া, শ্রীরামপুর, হুগলির ফুটবল। শিয়ালদহ-নৈহাটি লাইনই বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালি ফুটবলারদের অস্তিত্ব। লাল-হলুদের বুধবারের ১১ জনে ওই মুখগুলো কেউ নেই। ছিলেন ৫ পাহাড়ি, ২ পঞ্জাবি, ১ জন মালয়ালি, ৩ বিদেশি।
কসমোপলিটন টিমটার গতি এবং ফিটনেস চমকে দেয়। হঠাৎ হঠাৎ গতির আগুনে প্রতিপক্ষকে ছাই করে দিতে পারে। কিন্তু বুদ্ধির প্রয়োগ কম। পপকর্ন, চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে দলের গতির তারিফ করার ফাঁকে গ্যালারি হঠাৎ আবিষ্কার করে, দলটার কোচ এক জন ব্রিটিশ। টেরি কুপারের সহকারী কোচ হয়ে কাজ শুরু। তাই এত লং বল স্টাইলে গোলের খোঁজ। |
কিন্তু এত কথায় কী এসে যায়, যদি জয়ের হ্যাটট্রিকে তিনটি দুর্দান্ত গোল হয় তিনটি নিখুঁত পরিকল্পনায়?
মর্গ্যানের প্ল্যান ‘এ’-- টোলগেকে দিয়ে আক্রমণ দুটো উইংয়ে ছড়ানো। টোলগের পায়ে বল এলেই, গতির এক নাম ইস্টবেঙ্গল হয়ে যায়।
মর্গ্যানের প্ল্যান ‘বি’ হঠাৎ হঠাৎ গোল লক্ষ করে পেন, সঞ্জু, রবার্ট, নির্মলদের দূরপাল্লার শট। বিপক্ষকে আন্দাজ না দিয়ে।
মর্গ্যানের প্ল্যান ‘সি’ ম্যাচ ড্র থাকলে এক ঘণ্টার মাথায় স্ট্রাইকার ও মিডফিল্ডার বদল। আধ ঘণ্টা বাকি থাকতে পরিস্থিতি বুঝে বিদেশি বদলে ফেলা। দ্বিতীয়ার্ধে আরও বৈচিত্র।
প্ল্যান ‘বি’ থেকেই ১-০ এ দিন। টুইটারে ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় নির্মল কখন যে পুণে বক্সের কাছে উঠে এসেছেন, কেউ খেয়াল করেননি। লুসিও, টেরি, পুওলদের দেখে দেখে এখন ভারতীয় স্টপাররাও এই চেষ্টা করছেন। বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত শটে গোল নির্মলের। তিন মিনিটের মধ্যেই লেস্টারের ১-১। ইস্টবেঙ্গল স্টপাররা তখন জায়গায় নেই। এর পরেও ওপারা ম্যাচ-সেরা হলেন কী ভাবে?
প্ল্যান ‘এ’ থেকে ২-১। মর্গ্যান যা সেরা গোল বাছলেন। টোলগে গতি বাড়িয়ে পেনের সঙ্গে যে ভাবে গোল করলেন, তাকেই সার্থক যুগলবন্দি বলে। পেনই লাল-হলুদের মস্তিষ্ক। |
দুটো রাস্তা থেকে যদি গোল হয়, তা হলে ‘প্ল্যান সি’ বাকি থাকে কেন? ৩-১ হয়ে গেল পরে নামা অ্যালান গাও-এর দূরপাল্লার সোয়ার্ভিংয়ে। ভয়ঙ্কর সুন্দর গোল। ওটা দেখেই বোঝা যায়, কেন গাওকে ব্রিটিশ ফুটবলে প্রচুর লোক চেনে। গুগল সার্চ দিলে তাঁর নামই কেন সবচেয়ে বেশি আসে আই লিগের অন্যদের তুলনায়। কেন, ফিফা ০৯ ভিডিও গেমে তিনি।
বুঝুন ব্যাপার, পুণে দলের দুই স্টপারের নাম চিকা ও শ্রীকান্ত। ক্রিকেটার শ্রীকান্তের ডাকনাম ‘চিকা’ না? ব্যাট করার ফাঁকে শ্রীকান্ত লেগ আম্পায়ারের দিকে সরে যেতেন মনঃসংযোগ করতে। আর পুণের শ্রীকান্ত ও চিকা ম্যাচে মাঝেমাঝেই মনঃসংযোগ হারিয়ে ফেলেন। প্রথম দুটো গোলই ওই জন্য। তবে গাওয়ের গোলে তাঁদেরও কিছু করার নেই।
ডেরিক পেরিরা বাড়ি ফেরার সময় বলছিলেন, “ইস্টবেঙ্গল-পুণে ম্যাচ মানেই আমার গোলকিপারের কপাল খারাপ।” ফেড কাপে এই ম্যাচে চোট পেয়ে ছিটকে যান সুব্রত। এ দিন সুব্রতর ডেপুটি শাহিনলালকে চোট নিয়ে হাসপাতালে যেতে হল ২৬ মিনিটে। ভাল কিপার পিছনে থাকার নির্ভরতা ডেরিকের দলটা পেল না।
ম্যাচ শুরুর পৌনে এক ঘণ্টা আগে সল্টলেক স্টেডিয়ামে বেহালায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হয়ে যায়। বিরতিতেও সেই সুর। যুবভারতী এখনও শাকিরাকে ফুটবলে ঢুকতে দেয়নি। অনেক ফুটবলার বলেন, এমন সুরে শরীর ঝিমিয়ে যায়। ইস্টবেঙ্গল অবশ্য গতির রথেই থাকল সারাক্ষণ। আই লিগের অন্যতম গতিময় তারা।
ফেড কাপে কেন ইস্টবেঙ্গল রেফারির সাহায্য পাবে, প্রশ্ন তুলছিল অন্য দল। আই লিগে উল্টো দৃশ্য। রেফারিং ডুবিয়ে যাচ্ছে মর্গ্যানকে। চার্চিল ম্যাচে ন্যায্য গোল বাতিল হয়েছিল। এ দিন টোলগের শট বক্সে গুরজিন্দরের হাতে লাগা সত্ত্বেও নিশ্চিত পেনাল্টি দিলেন না মণিপুরি রেফারি অজিত মিতেই। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা প্রতিবাদপত্র জমা দিচ্ছেন। ডাইভ দিয়ে টোলগের হলুদ কার্ডও, তাঁদের মতে পেনাল্টি। মাঘো সিংহকে তো তিন ম্যাচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অজিত মিতেইকে কী করা হবে?
অজিত মিতেই নন। এখন ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির আক্ষেপ ও যন্ত্রণার নাম টোলগে ওজবে। স্বপ্নের গোলটা করে বেরিয়ে আসার সময় যিনি অনেকক্ষণ বিলবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথা নিচু করে। তখনই বুঝে গিয়েছেন, বড় ম্যাচে নেই। আক্ষেপ থেকে তৃপ্তি ও সাহস খোঁজার চেষ্টায় শুধু মর্গ্যানই, “বড় ম্যাচে বিদেশি বাছা নিয়ে অন্তত দোটানায় ভুগতে হবে না।”
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, রবার্ট, নির্মল, ওপারা, নওবা, ভাসুম, সুশান্ত (পাইতে), পেন, সঞ্জু, টোলগে (গাও), বলজিৎ (রবিন)। |