মানুষকে ঠিক কী দিয়ে মাপব? তেমন কোনও মাপনী হয় কি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতায় বলেছিলেন, তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ! তাঁর আরও নানা বাক্যের মতোই এই কথাটির ভিতরেও একটি কূটাভাস ছিল। তা হলে কি কীর্তির বাইরেও আরও কিছু থাকে যা দিয়ে কোনও ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে পারি? সমস্যা এই যে আমরা কীর্তির নিরিখেই মানুষের মূল্যায়ন-সংক্রান্ত নানাবিধ ভাবনা ভাবতে অভ্যস্ত। কীর্তির্যস্য স জীবতি...
অথচ, কোনও কোনও মানুষের সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারি, শুধুই কীর্তি নয়, সফলতা নয়, আরও কিছু, অন্তর্গত আরও একটা কিছু আমাদের ভিতরে খেলা করে। ‘বটুকদা’, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তেমনই এক জন। কীর্তিমান তো বটেই, উত্তরকাল সেই কীর্তির কথা সসম্ভ্রমে স্মরণ করবে, কিন্তু যাঁরা সেই মানুষটির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা জানেন, নিছকই কীর্তির মাপকাঠিতে মানুষটিকে বিচার করা কঠিন। অনুচিতও বটে। কারণ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন আশ্চর্য একটি মানুষ।
খুব উদার। প্রাণখোলা। গভীরে অনেকখানি প্রাণ থাকলেই বোধহয় ও রকম প্রাণবন্ত হওয়া যায়। এবং, তা না হলে
|
রেখাঙ্কন: সত্যজিৎ রায় |
সত্যিই বোধহয় অতি সম্পন্ন জমিদারগৃহ ছেড়ে পথের ধুলোয় নেমে আসা যায় না। তাঁর জন্ম যদিও শ্রীরামপুরে মাতামহের গৃহে, কিন্তু মৈত্র পরিবার পাবনার শিতলাই অঞ্চলের জমিদার। অথচ, সেই বাড়ির সন্তান সটান নেমে এলেন মধুবংশীর গলিতে। বাম রাজনীতির দীক্ষাই তাঁকে টেনে আনল রুক্ষ্ম জীবনে। ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু, এ কথা এমন সার্থক ভাবে আর ক’জনই বা বলতে পারেন বটুকদা ছাড়া?
বটুকদার কথা উঠলেই গানের প্রসঙ্গ অনিবার্য। নবজীবনের গান থেকে রবীন্দ্রনাথের গান, দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। নবজীবনের গান যখন প্রথম শুনি এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার, তখন আমি বালকমাত্র। কৃষ্ণনগর ছেড়ে তখন বাবা কর্মসূত্রে হাওড়ায়, সঙ্গে আমরাও।
আজ, এই বিলবোর্ডের আলোয় ভাসা জীবনে সেই গান অকস্মাৎ ধূসর পাণ্ডুলিপি বলে মনে হতেই পারে কারও,কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, স্বপ্নপ্রদোষের মত একটা সময়ে সেই গান আমাদের মনে ঠিক কী উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, আজ এত বছর পরেও তা অনুভব করি স্পষ্ট। তখন গোটা দেশ মারের সাগর পাড়ি দিচ্ছে। সেই অনিশ্চিত প্রহরে আমরা শুনলাম নবজীবনের গান। আক্ষরিকই, ‘নবজীবন’! এ ছাড়া আর কী বলেই বা সেই সঙ্গীতের ব্যাখ্যা করা যাবে? |
তখন ভাবতেই পারিনি, এক দিন এই নবজীবনের গানের স্রষ্টা আমার অসমবয়সী এক বন্ধু হয়ে উঠবেন! সত্যিই যখন বটুকদার কাছাকাছি আসার সুযোগ হল, তখন বয়সের বেড়া যে কোথায় ভেঙে বেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি ছিল আশ্চর্য। তার সঙ্গে গান। এবং, আরও একটি সাঁকো ছিল সিনেমা। মানিকদার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটি ছিল মধুর। এবং, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সঙ্গীতজ্ঞান সম্পর্কে, রবীন্দ্রনাথের গানে তাঁর অধিকার সম্পর্কে মানিকদার ধারণা ঠিক কী রকম ছিল, তা একটি দৃষ্টান্ত থেকেই পরিষ্কার। সত্যজিৎ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রের সঙ্গীত পরিচালকের নাম জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। পাশাপাশি, আরও একটি তথ্য। ঋত্বিক ঘটকের দু’টি আশ্চর্য ছবি, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র সঙ্গীত পরিচালকের নাম জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। আসলে, ঋত্বিকদা এবং মানিকদা দু’জনের সঙ্গেই বটুকদার সখ্য ছিল বিস্ময়কর। ভাবতে ইচ্ছে করে, ঠিক কী ভাবে ঋত্বিক ঘটক এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের যুগলবন্দিতে জন্ম নিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানটির সঙ্গে চাবুকের ধ্বনির অবিস্মরণীয় প্রয়োগ।
বটুকদা সম্পর্কে আরও একটি বিস্ময়ের কথা উল্লেখ করে শেষ করি। সেই বিস্ময়টির নাম ‘মধুবংশীর গলি’। এবং, সেই সূত্রে আমার বিস্মিত অভিভবের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আরও একজন। শম্ভু মিত্র। একটি আশ্চর্য কবিতার কণ্ঠরূপ যে আরও কতটা বিস্ময়কর হয়ে উঠতে পারে, তারই নিদর্শন শম্ভুদার গলায় এই কবিতার আবৃত্তি।
কবিতাটির আমার খুবই প্রিয়, বেশ কিছু পংক্তি স্মৃতিতে এখনও গ্রথিত। কয়েক বার মনে হয়েছে, আবৃত্তি করলে কেমন হয়! কিন্তু, কখনও আবৃত্তি করিনি। স্মৃতি এসে পথ আটকেছে। এই কবিতাটির মধ্যে বটুকদা এবং শম্ভুদার একটি যৌথ রসায়ন আমার মতো অনেকেরই পুরনো সময়ের একটা টুকরো। তার পাশে অন্য কিছু রাখতে আর ইচ্ছে করেনি।
বটুকদা শতবর্ষে উপনীত।
স্মৃতিগুলো এখনও খুব জীবন্ত।
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়... |