ছত্তীসগঢ়ের সমস্যা আবার অন্য রকম। সেখানকার কিছু কিছু অঞ্চলের দারিদ্র জঙ্গলমহলের দারিদ্রকে ছাড়িয়ে যায়। এখানে যদি বা বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু জমির কাজ এঁরা পান, সেখানে মানুষের হাতে বারোমাসই কোনও কাজ নেই। অরণ্যের ফল-পাতা এই-ই তাঁদের জীবিকা। মহুয়া বিক্রির টাকায় সংসার পালন। অরণ্যনির্ভর এই জীবনযাপনে আধুনিক পৃথিবী অনুপস্থিত। কিন্তু সেই অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়াটা আধুনিক পৃথিবীর পক্ষে খুব জরুরি হয়ে ওঠে। ‘উন্নয়ন’-এর যুক্তিতে আদিবাসী মানুষের জল-জমি জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নেতৃত্বে থাকে রাষ্ট্র। সমাজ পরোক্ষ সায় দেয়।
আর আদিবাসী মানুষ যখন নিজেদের অধিকার বজায় রাখার জন্য মরিয়া প্রতিরোধে শামিল হন, তখনও সেই দমননীতি দিয়েই তাঁদের শায়েস্তা করার প্রক্রিয়া চালু হয়। সংসদীয় কোনও রাজনৈতিক দলই সেই অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হয় না। যদিও প্রতিটি দলই কখনও না কখনও আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকারকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি বনাঞ্চল অধিকার আইনও পাশ হয়েছে। কিন্তু সমস্ত কিছুর তলায় তলায় জমি থেকে আদিবাসী উচ্ছেদের প্রক্রিয়াও জারি থাকে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি আমাদের সমাজেরই প্রতিফলন। এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে একমাত্র রাজনৈতিক দল মাওবাদীরাই আদিবাসীদের জল-জমি-জঙ্গলের অধিকারের সপক্ষে দাঁড়িয়ে ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ছত্তীসগঢ়ের এক সমাজকর্মী, যিনি একেবারেই মাওবাদী নন, গল্প করেছিলেন কেমন করে মাওবাদীরা সেখানকার দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখে জড়িয়ে থাকেন। হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠা কোনও মেয়েকে রাত্রির অন্ধকারে কার্যত ঘাড়ে করে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা যদি পৌঁছে দেন কোনও মানুষ, তখন তিনি আর দূরের কেউ থাকেন না, গ্রামের নিজের লোক হয়ে যান। নিয়মগিরিতে কুড়ি টাকায় এক বস্তা (কুড়ি কিলো) আম কিনে নিয়ে গিয়ে মহাজন পঞ্চাশ টাকা কিলো দরে বিক্রি করে। সেখানকার এক আদিবাসী মধ্যবয়সী মানুষ বলেছিলেন: ‘ঠিক দরজা জানি না। চাইতেও পারি না। জীবন তো এই ভাবে কাটল। এখন এই মাওবাদীরা এসে দাম ঠিক করে বেচে, তবু দুটো পয়সা হয়।’ ছত্তীসগঢ়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গিয়ে গাঁধীবাদী নেতা হিমাংশু কুমার বলেছেন, ‘যে মানুষটা পীড়িত, সে লড়বেই। এ লড়াইটা গরিব মানুষের লড়াই। নকশালপন্থীরা শামিল হয়েছেন মাত্র।’ |
এখানেই লালগড়ের সঙ্গে ছত্তীসগঢ়ের একটা তফাত আছে। লালগড়ের মানুষের বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াইয়ে সে ভাবে মাওবাদীরা যুক্ত নন। তাঁরা অনেকেই, এ ক্ষেত্রে বাইরের লোক। ছত্তীসগঢ়ের মতো স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ এখানে কমই। এমনকি, এমনও শুনেছি যে, স্কুলপড়ুয়া কিশোরকে মাওবাদী দলে, খানিকটা জোর করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গ্রামের মায়েরাই এ কথা বলেছেন। যদি সাধারণ ভাবে জঙ্গলমহলের মানুষের সমর্থন মাওবাদীদের দিকে থাকত, তা হলে মাওবাদীদের কাহিনি তাঁরা আমাদের বলতেন না।
নিয়মগিরিতে নিজের অভিজ্ঞতায় জানি, আদিবাসীদের নিজস্ব উৎসবের জোগাড়ে মাওবাদীরাও সমান অংশ নেন। এক সময় বাইরে থেকে এলেও, দিনে দিনে ঘরের লোক হয়ে উঠেছেন।
ভয় হয় আজকের জঙ্গলমহলকে দেখে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক দাবি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর বহুস্বরকে সেখানে পদদলিত করার চেষ্টা চলছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যাবতীয় গণতান্ত্রিক কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলির পাঁঠার মতো দেগে দেওয়া হয়েছে ‘মাওবাদী’ তকমা। নির্বিচারে এই দেগে দেওয়া এক দিন রাষ্ট্রের কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে; কিন্তু তার জন্য আর কত রক্তপাত দেখতে হবে আমাদের?
স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের কোনও তোয়াক্কা না করে, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়নের বিদেশি মডেল কতখানি গ্রহণযোগ্য এক বারও ভেবে দেখা হয়নি। আদিবাসীদের নিজেদের জল সংরক্ষণের পদ্ধতি আছে, অরণ্য সংরক্ষণের ধারা আছে সে সবকে মর্যাদা দিয়ে যদি সাহায্যের হাত বাড়ানো হত, তা হলে সেই উন্নয়ন অনেকটাই সর্বাঙ্গীণ হত।
কিন্তু আমাদের তো গোড়ায় গলদ। আমরা তো কোনও দিনই তাঁদের পদ্ধতিকে, ধ্যানধারণাকে, অভিজ্ঞতাকে মর্যাদা দিইনি। দিতে শিখিনি। নিজেদের পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে আর কোনও সত্য নেই এ আমরা ধরেই নিয়েছি। তাই, মনে হয় সবচেয়ে আগে রাষ্ট্রকে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সমাজকেও স্বীকার করতে হবে যে, আদিবাসীদের জীবনধারা, মূলধারার সঙ্গে না মিললেও তাঁরা সহনাগরিক। নিজেদের অধিকারেই নিজেদের মতো করে তাঁরা বাঁচবেন। সেইখানে রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই হস্তক্ষেপ করার।
জীবন এবং জীবিকা কেড়ে নেওয়ার কোনও অধিকার নেই।
ছত্তীসগঢ় প্রসঙ্গে হিমাংশু কুমারের পরিসংখ্যানে ফিরে আসি। তিনি বলছেন, ‘সালভা জুড়ুম তৈরি হওয়ার আগে মাওবাদীরা সংখ্যায় ছিল মাত্র ৫০০০। সালভা-জুড়ুম হওয়া পরে মাওবাদীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১,১০,০০০ বাইশ গুণ বেশি। অপারেশন গ্রিন হান্ট-এর পর প্রত্যেক জীবিত আদিবাসী এক জন মাওবাদী ফুলটাইমার হবেন।’
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত দমননীতি দিয়ে কোনও প্রকৃত প্রতিবাদকে থামানো যায়নি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ হয়েছিল আলোচনার টেবিলে। সব রাজনৈতিক দলই এই কথা জানেন। কিন্তু তবু সমস্যার গভীরে ঢুকে আলোচনার প্রস্তুতি নেয় না রাষ্ট্র।
কারণ, তা হলে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করা যায় না।
শান্তিপূর্ণ ভাবে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আলোচনার টেবিল পর্যন্ত এগিয়েও দিল, সেই আন্দোলনকে যদি বন্দুক দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলে তা সামান্য সময়ের জন্য চুপ করলেও, আদতে বেড়েই চলে। সত্তরের দশকে একটা গোটা প্রজন্মকে রাষ্ট্রীয় হিংসার বলি হতে হয়েছিল।
সেই অভিজ্ঞতা আমাদের কি কিছুই শেখায়নি? |