বালকটি মরিল। ক্রুদ্ধ হস্তীর পদতলে পড়িয়া তাহার প্রাণ গিয়াছে। বর্ধমান শহরের ঘটনাটি মর্মান্তিক সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হইল, দোষ কাহার? এই ঘটনায় মূল যে দুই পক্ষ, দোষ যে তাহাদের নহে, তাহা স্বীকার করিতে হইবে। মত্ত হাতি ও নিহত বালক মূল ঘটনার নিমিত্তমাত্র। আনারকলি নামক হাতিটিকে লইয়া তাহার মাহুত লোকালয়ে খেলা দেখাইতে বাহির হইয়াছিল। হাতির কাণ্ডকারখানা দেখিয়া আমোদ পাইয়া মানুষজন পয়সা দিবেন, ইহাই ছিল মাহুতের উদ্দেশ্য। খেলা দেখাইয়া, বালকদের পিঠে চাপাইয়া যে অর্থ মিলিবে সেই অর্থে হাতি ও তাহার মাহুতের খোরাকি জুটিবে এমন ঘটনা তো নূতন নহে। শুধু হাতি কেন, অপরাপর পোষ্যদেরও নানা সময়ে শহর পথে চোখে পড়ে। হাতি, বাঁদর, ভাল্লুক লইয়া মাঝে মাঝে তাহাদের চালকেরা লোকালয়ে খেলা দেখাইয়া যান। সেই খেলা দেখিয়া বাচ্চা-বুড়ো সকলে মজা পাইয়া থাকেন, পয়সাও দিতে কার্পণ্য করেন না। আর এই খেলা দেখানোর সময় বালকরা দল বাঁধিয়া পোষ্য খেলুড়েটিকে টিটকারিও দিয়া থাকে। লেজ মলিতে দ্বিধা করে না। এ ক্ষেত্রে জন্তুটি হাতি। আয়তনে ও সামর্থ্যে বাঁদর বা ভাল্লুকের চাহিতে প্রবল। কাজেই বালকদের পিছনে লাগিবার ও লেজ মলিবার ফল ভাল হয় নাই। হাতি রাগিয়াছে এবং লহমায় প্রাণঘাতী আঘাত হানিয়াছে। বালকদের আচরণ হাতির মত্ততার ও সেই মত্ততা একটি বালকের মৃত্যুর কারণ। তবু এই হাতি এবং বালক নিমিত্তমাত্র। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনাটি গভীর এক সামাজিক অসামঞ্জস্যের পরিচয়বাহী। পশুপ্রেমিকগণ হাতির পক্ষেই কথা বলিবেন। বলিবেন বন্য পশুদের জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলা চলিবে না। তাহাদের রক্ষার ও ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইবে। খেলা দেখাইবার নাম করিয়া লোকালয়ে লইয়া গিয়া পোষ্য জন্তুদের বিরক্ত করিবার অনৈতিক অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না। বন্য ও পোষ্য জন্তুরা মনুষ্য সমাজের আনন্দ বিধানের জন্য এ ধরাধামে অবতীর্ণ হয় নাই। ইহা যে হক কথা, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্ন উঠিতে পারে, হাতির নিরুপায় মাহুত কী করিবেন? তাঁহার অন্ন সংস্থানের কী হইবে? এই প্রশ্নগুলিরও সদুত্তর দেওয়া চাই, কিন্তু পশুপীড়ন তাহার উপায় হইতে পারে না। তবে সবচেয়ে বড় যে অসামঞ্জস্য, তাহা নিহিত রহিয়াছে সামাজিক মনের মধ্যে। নির্জীব সামাজিক মন কেবল সব বিষয় লইয়া আমোদ করিতে শিখিয়াছে, তলাইয়া ভাবিতে শিখে নাই। যে বালকের দল হাতিটিকে উত্ত্যক্ত করিতেছিল তাহারা তো এই সামাজিক মনটিকে বহন করিতেছে মাত্র, অসচেতন ভাবে বহন করিতেছে। এই মন কাহারও অবস্থা বিচার করিয়া সমাধানের পথ অনুসন্ধান করে না তাৎক্ষণিক আমোদে মাতিয়া খেলা দেখিয়া দায় এড়াইয়া চলিয়া যায়। তাই হতভাগ্য বালকটিকে দোষ দিয়া লাভ নাই, হাতিটিকে দোষ দেওয়ার তো কোনও অর্থই নাই। সামাজিক মনটিকে প্রশ্ন করিবার সময় আসিয়াছে। যে মন হাতি ও তাহার মাহুত উভয়ের অবস্থা না বুঝিয়া কেবল খেলা দেখিতে ও দেখাইতে চাহে তাহার কপালে এ রূপ বিড়ম্বনা অনিবার্য। এই অসংবেদী সামাজিক মনের ব্যাধির প্রতিকার আবশ্যক। |