প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের শ্রীলঙ্কা যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়, তাহা প্রমাণ করিতে দেশের সংবাদ বিষয়ক সাতটি ওয়েবসাইট বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। দেশের তথ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, ওই সব ওয়েবসাইটে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হইতেছিল। শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যম কার্যত সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত। দেশের বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলি নিয়মিত সরকার ও তাহার উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের সপ্রশংস বন্দনা গাহিয়া চলিয়াছে। মুদ্রিত গণমাধ্যম অর্থাৎ সংবাদপত্রগুলি রাজাপক্ষের ঝটিকাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর হইতে কার্যত স্বেচ্ছা-সেন্সরশিপের মুচলেকা দিয়া কাজ চালাইতেছে। সরকারবিরোধী মতামত প্রকাশ করিলে কী হইতে পারে, তামিল-বিরোধী যুদ্ধের পর্বে দেশের একাধিক বিশিষ্ট ও বিবেকবান সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ড কিংবা ‘অদৃশ্য’ হওয়ার ঘটনা হইতে সংবাদপত্রগুলি তাহা শিখিয়া লইয়াছে। এই অবস্থায় ইন্টারনেটে চালু ওয়েবসাইটগুলিই ছিল শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে তথ্য জানার একমাত্র নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য সূত্র। সেগুলিও বন্ধ করিয়া রাজাপক্ষে সরকার শ্রীলঙ্কাকে লৌহ-যবনিকার অন্তরালে লইয়া যাইতে সচেষ্ট।
অতঃপর শ্রীলঙ্কা একদলীয় কমিউনিস্ট স্বৈরাচার শাসিত দেশগুলির মতো রাজনৈতিক স্বৈরাচার অবাধে অনুশীলন করিতে পারিবে। এ ব্যাপারে রাজাপক্ষের ঘনিষ্ঠ মিত্র গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের নজির অনুসরণ করিতে সরকার বদ্ধপরিকর। দেশের ভিতর কী হইতেছে, বিদেশে তো বটেই, দেশের ভিতরেও সর্বত্র তাহার সংবাদ পাওয়া ইহার ফলে দুষ্কর হইয়া উঠিবে। এল টি টি ই নিশ্চিহ্ন হইলেও সংখ্যালঘু তামিল জাতিসত্তার উপর যে দমননীতি ও নির্যাতন চলিতেছে, বিবেকবান সিংহলি জনমত তাহার কোনও হদিশ পর্যন্ত পাইবে না। দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিকারের পথও রুদ্ধ হইবে। গণ-আন্দোলন, জনবিক্ষোভ, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দাবিতে জমায়েত হওয়ার স্বাধীনতা এবং সুযোগও ক্রমে সঙ্কুচিত হইবে, যেহেতু সামগ্রিক ভাবে সংবাদসূত্রগুলিরই কণ্ঠরোধ করা হইতেছে। স্বভাবতই গণতান্ত্রিক বিশ্ব রাজাপক্ষে সরকারের এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি, রাষ্ট্রপুঞ্জ, রেড-ক্রস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েল্থ তো বেশ কিছু কাল ধরিয়াই সিংহলি সেনাবাহিনীর হাতে অসামরিক তামিলদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিকারহীন অপরাধগুলির বিরুদ্ধে মুখর। ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদও সর্বত্রই ধ্বনিত হইতেছে। তবে রাশিয়া, চিন, ইজরায়েল ও ভারতের মতো প্রভাবশালী মিত্ররাষ্ট্রের প্রশ্রয় রাজাপক্ষে সরকারকে ক্রমশই উত্তরোত্তর বেপরোয়া করিয়া তুলিতেছে। মুক্ত দুনিয়ার প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করার সাহসও শ্রীলঙ্কা সেখান হইতেই সঞ্চয় করিতেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত। যে-দেশে সরকারি ভাষ্যের বিপরীত কোনও ধারণা পোষণ বা ব্যক্ত করার অধিকার স্বীকৃত নয়, সে দেশ গণতান্ত্রিক দেশ নয়। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন নয়। নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে যে নানা ভাবে স্বৈরাচারীরা নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করিতে পারেন, বরখাস্ত সেনানায়ক শরৎ ফনসেকার ক্ষেত্রে তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শাসক হইয়া ভিন্ন মত পোষণের অধিকার মঞ্জুর করিতেছেন কিনা, গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রকে কাজ করার পূর্ণ স্বশাসন দিতেছেন কিনা, রাস্তায়-ঘাটে সরকারের, প্রেসিডেন্ট-মন্ত্রী-রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধিতা করিলে তাহা বরদাস্ত করা হইতেছে কিনা, তাহার উপরেই গণতন্ত্র নির্ভর করে। এই কষ্টিপাথরে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র রাজাপক্ষে পরিবারের স্বৈরতন্ত্র রূপেই প্রতিভাত হয়। তামিল-বিজয়ের জের টানিয়া উগ্র সিংহলি জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে সওয়ার রাজাপক্ষে কিছু কাল অবশ্যই তাঁহার পরিবারতন্ত্র চালাইতে পারিবেন। অন্তত যত দিন অর্থনৈতিক অবরোধে তাঁহার সরকারকে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার ফিরাইয়া দিতে বাধ্য করা না হইতেছে। কিন্তু সব স্বৈরাচারই যে এক দিন উৎখাত হয়, আরব বসন্ত তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। |