গানে গানেই বিদায় ভূপেন হাজরিকার, সাক্ষী জনসমুদ্র
তিনি গেয়েছিলেন, “ময় যেতিয়া এই জীবনর মায়া এরি গুসি যাম/আশা করু চিতার কাখতে তুমার হহারি পাম।” বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, আমি যখন জীবনের মায়া কাটিয়ে চলে যাব, আশা করি চিতার পাশে তোমায় পাব। কাকে উদ্দেশ্য করে গেয়েছিলেন, জানা নেই। তবে আজ,গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, শেষকৃত্যস্থলে হাজির থাকা হাজার তিরিশেক অসমবাসীর সকলেই, চিতার পাশে পৌঁছতে আকুল। সেখানে দল-মত-ধর্মের কোনও বিভেদ ছিল না। এই মহামিলনের স্বপ্নই তো গেয়েছিলেন সুধাকণ্ঠ। মৃত্যুতে যা ঘটিয়ে ফেললেন। ছেলে পুন্নাগ তেজ হাজরিকা পটেল, চন্দন কাঠে শোয়ানো ভূপেন হাজরিকার মুখে আগুন ছোঁয়ানোমাত্র সে এক আবেগের বিস্ফোরণ। এরপর টানা তিন ঘণ্টা ধরে, ভূপেন্দ্র যুগের সমাপ্তি ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকল। জনসমুদ্র মৌন সাক্ষী। চিতাস্থলে মুখর কেবল ভূপেনের গান।
সকাল ৬টায় জাজেস ফিল্ড থেকে মরদেহ নিয়ে কনভয় বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাঁধভাঙা জনসমুদ্রের চাপে বেরোতে সাতটা বেজে যায়। এরপর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কনভয় করে ভূপেনবাবুর দেহ মালিগাঁও হয়ে জালুকবাড়ি পৌঁছয়। গোটা রাস্তা শববাহী ট্রাকের সঙ্গে দৌড়লেন মানুষ। ৯টা নাগাদ চিতাস্থলে পৌঁছয় গাড়ি। ততক্ষণে সেখানে হাজির লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ, প্রধানমন্ত্রী ও সনিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী পবনসিংহ ঘাটোয়ার, রাজ্যপাল জানকীবল্লভ পটনায়ক ও মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ।
১৯৮৮ সালের এপ্রিলে যেখানে অনুষ্ঠান করেছিলেন ভূপেনবাবু, সেখানেই, তিরিশ বছরের পুরনো চন্দন গাছ কেটে চিতা সাজানো হয়। দশটা আঠারো মিনিটে পরপর তিনবার আকাশপানে গর্জে উঠল ১৪টি রাইফেল। চিতায় উঠলেন সকলের ‘ভূপেনদা’। কান্নায় ভেঙে পড়লেন পরিবার-পরিজন। চোখের জলে গান ধরলেন হাজার হাজার মানুষ। একে একে বিশিষ্টজন ও আত্মীয়দের অন্তিম শ্রদ্ধা জানানোর পালা শেষ হল। ১০টা ২৫ মিনিটে মুখাগ্নি করলেন তেজ হাজরিকা। উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরে আসা বাহুল গাঁধী পরে এক সময় গিয়ে দেখা করেন পিতৃহারা তেজের সঙ্গে।
বাবা ভূপেন হাজরিকার চিতায় আগুন ছেলে তেজের।
বুধবার গুয়াহাটির জালুকবাড়িতে উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।
গল্পটা এখানে শেষ হলে কিছুটা পূর্ণতা বাকি থেকে যেত। প্রিয়ম্বদা পটেল ওরফে প্রিয়ম হাজরিকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পরে বছর দেড়েকের যে ছেলেটি মায়ের সঙ্গে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছিল, সেই তেজ এখন ষাট বছরের বৃদ্ধ। বাবাকে কখনও কাছে পাননি। অসমের সঙ্গে তাঁর কোনও নাড়ির টানও ছিল না। কিন্তু মায়ের কথায় পিতার অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে অসম আসার পর থেকেই বিহ্বল দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা পুত্র। ভূপেনবাবু ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার পরে আজ বাবার চিতাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা তেজকে একবার ছুঁতে, তাঁর অটোগ্রাফ নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তা দেখে তেজ বললেন, “একটা মানুষের জন্য এত দরদ, এত আবেগ ছিল অসমে! ভাবা যায় না। আমায় আবার আসতেই হবে এখানে। রঙালি বিহুতেই আসব।”
আর, যে ভালবাসার জন ভূপেনবাবুকে ঘিরে ছিলেন জীবনের শেষ দুই দশক, বহু বিতর্ক যাঁকে ঘিরে, সেই কল্পনা লাজমি বলেন, “আমি স্বামী-প্রেমিক-ভাই-বন্ধু সব হারালাম। ওঁকে আমি সারাজীবন ভালবাসব। আমি বিশ্বাস করি না তিনি আমায় ছেড়ে যেতে পারেন।”
অসমবাসীও বিশ্বাস করে না। তাই তো তাঁর চিহ্ন, স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে কত না প্রয়াস। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলা বিভাগের নাম ভূপেনবাবুর নামে করা হচ্ছে। জেলায় জেলায় বসছে মূর্তি। সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ভূপেনবাবুর চিতাভস্ম প্রতিটি জেলায় ভাগ করে দেওয়া হবে। যাতে সকলে, নিজেদের মতো করে অসমরত্নকে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। অসুস্থ ভূপেন ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, “পরের জন্মে সচিন তেন্ডুলকর হয়ে জন্মাতে চাই।” তেণ্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরি দেখে যেতে পারলেন না সচিনভক্ত গায়ক। আজ সচিন যখন ৭৬-এ আউট, ভূপেনদা তখন ৮৬তে পুড়ছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.