নারকেলগাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন জুমান আলি।
মেরুদণ্ডে মারাত্মক চোট পাওয়া যুবকটিকে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পরিজনেরা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন সাতসকালে। বেলা এগারোটা নাগাদ কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানিয়ে দিলেন, এই হাসপাতাল জুমানের মতো ‘ইমার্জেন্সি’ রোগীদের চিকিৎসা করে না!
তা হলে তিনি যাবেন কোথায়?
জুমানকে এক বারের জন্য স্পর্শ না-করেই ডাক্তারেরা তাঁকে ‘রেফার’ করে দিলেন পিজি-তে। একই ভাবে পর পর ‘রেফারড’ হতে থাকলেন গাড়ি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়ে সংজ্ঞাহীন শ্যাম দলুই, মাথা ঘুরে পড়ে ঘাড়ে আঘাত পাওয়া রামরতন বালার মতো বিভিন্ন আপৎকালীন রোগী। ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি’ (বিআইএন) থেকে। |
পাঁচ মাস আগে, ২৬ মে সকালে মহাকরণে যাওয়ার পথে আচমকা গাড়ি ঘুরিয়ে এখানেই ঢুকে পড়েছিলেন সদ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি পরিষেবা নেই দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, শিগগিরই বিআইএনে ইমার্জেন্সি চালু হবে। সময় বয়ে গিয়েছে নিজের মতো। জরুরি বিভাগের দেখা এখনও পায়নি বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকর হল না কেন? বিআইএনের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র থেকে শুরু করে সার্জারির প্রধান সমরেন্দ্র ঘোষ সকলেরই স্পষ্ট বক্তব্য, “এখানে মাথা বা মেরুদণ্ডের চোট-আঘাতের রোগী ভর্তি করলে স্নায়ু সংক্রান্ত জটিল রোগের চিকিৎসা আর হবে না। অতএব বিআইএনে ইমার্জেন্সি কখনওই খোলা হবে না।” তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি কি স্রেফ কথার কথা
হয়ে থাকবে?
হাসপাতালের কর্তারা বলছেন, “আমাদের ডাক্তারেরাই তো এসএসকেএমে গিয়ে নিউরো ইমার্জেন্সির রোগী দেখেন! তা হলে সমস্যা কোথায়?”
সমস্যা যে বিস্তর, তা পাঁচ মাস আগের আচমকা পরিদর্শনকালেই মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন বিআইএনে উপস্থিত রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা। ওঁদের অভিযোগ ছিল, নিউরো ইমার্জেন্সির অধিকাংশ রোগী এসএসকেএমে বেড পান না। পেলেও বিআইএনের ডাক্তারদের বারবার ‘কল বুক’ দিয়ে ডেকে আনতে আনতে এত সময় পেরিয়ে যায় যে, রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। বস্তুত এ সব শুনেই মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, এসএসকেএমের ‘ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’-এ শুধু বিআইএন থেকে পাঠানো রোগীদেরই ভর্তি করা হোক।
পাঁচ মাস পরে কী দেখা যাচ্ছে? |
দেখা যাচ্ছে, ওই দিন এসএসকেএমের ‘ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে’ ভর্তি হতে গিয়ে শয্যাই পেলেন না তারকেশ্বরের মহাদেব ঢালি, হরিদেবপুরের সুমিতা মুখোপাধ্যায় কিংবা কান্দির সরযূ প্রধানেরা। মহাদেববাবু মাথার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়েছেন, সুমিতাদেবীর বার বার খিঁচুনি হচ্ছে। তাঁর স্বামী পবিত্রবাবু বলছেন, “ওঁকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঠোক্কর খেতে হবে, কে জানে!”
কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলা সত্ত্বেও পিজি-র ওয়ার্ড বিআইএনের ইমার্জেন্সি রোগী ফেরাচ্ছে কেন?
এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “ভিক্টোরিয়া, কুইন্স-সহ এখানকার বিভিন্ন ওয়ার্ড সংস্কারের জন্য দীর্ঘ দিন বন্ধ। এখন বিআইএনের জন্য পুরো ওয়ার্ড ছেড়ে দিলে আমাদের রোগীরা কোথায় থাকবেন?”
গত ২৬ মে বিআইএনে ঢুকেই মুখ্যমন্ত্রী চলে গিয়েছিলেন এক্স-রে, এমআরআই সেন্টারে। ইনস্টিটিউটের তদানীন্তন অধিকর্তার কাছে কৈফিয়ত চেয়েছিলেন, “কেন এখানে মাত্র একটা ঝুরঝরে এমআরআই মেশিন? সিটি স্ক্যান মেশিন নতুন কেনা হচ্ছে না কেন? কেন হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় দামি যন্ত্রপাতি কাজে না-লাগিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে?” মমতা সে দিন এ-ও জানিয়েছিলেন, “আমার কাছে সব খবর আছে।”
এত ভর্ৎসনার পাঁচ মাস পরেও বিআইএন আছে বিআইএনেই!
নতুন এমআরআই মেশিন এখনও আসেনি। দেখা গেল, দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অরবিন্দ মাইতি। মেদিনীপুরের পিংলা থেকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। এমআরআইয়ের ‘ডেট’ পেয়েছেন চার মাস পরে। হতভম্ব অরবিন্দবাবুর প্রশ্ন, “অত দিন কি ও আদৌ বেঁচে থাকবে?” সোনারপুরের রঘুনাথ কুণ্ডু ‘ডেট’ পেয়েছেন দু’মাস বাদে। বাধ্য হয়ে বাড়ির লোক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এমআরআই করিয়ে আনার কথা ভাবছেন।
এবং বিআইএনের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নতুন এমআরআই মেশিন না-এলে এমনই চলবে। আদ্যিকালের একটা মেশিনে কোনওক্রমে ভর্তি রোগীদের এমআরআই হচ্ছে। আউটডোরের রোগীদের ডেট পেতে ছ’-আট মাস লাগে। পুরনো এন্ডোস্কোপ বা সিটি স্ক্যানের নতুন যন্ত্র কেনা হয়নি। অতি প্রয়োজনীয় সিরাম এক্স-রে মেশিনও আসেনি। অন্য দিকে প্রায় ছ’মাস আগে ৬ কোটি টাকা দিয়ে কিনে আনা ডিজিট্যাল সাবট্র্যাকশন অ্যাঞ্জিওগ্রাফি (ডিএসএ) যন্ত্র স্রেফ পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে। সেটি চালানোর ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ এখনও করে উঠতে পারেননি।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। |
বিআইএনের চিকিৎসকদেরই একাংশের অভিযোগ, এখান থেকে দিনের পর দিন রোগী ফেরানোর পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের হারও কমে গিয়েছে। কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
ইনস্টিটিউটের নিউরোসার্জারির প্রধান সমরেন্দ্র ঘোষের ব্যাখ্যা, “আগে অপারেশনের সংখ্যা দেখা হত। গুণগত মান দেখা হত না। আমরা এখন যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে বড় বড় অপারেশন করি। তাই সংখ্যা একটু কম-বেশি হতে পারে।” যদিও এই ব্যাখ্যা উড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের পূর্ববর্তী অধিকর্তা শ্যামাপদ গড়াই, মুখ্যমন্ত্রীর বিআইএন পরিদর্শনকালে তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ায় যাঁকে সাসপেন্ড হতে হয়েছিল।
শ্যামাপদবাবুর দাবি, “আগে অপারেশনের সংখ্যা আর
গুণগত মান, দুই-ই দেখা হতো। এর পক্ষে সমস্ত তথ্য-প্রমাণও
আছে।”
|