মুখ্যমন্ত্রী থেকে স্বাস্থ্য-সচিব কারও আবেদন-নিবেদন কাজে আসেনি। এমনকী, ‘কড়া ব্যবস্থা’র হুঁশিয়ারিও ব্যর্থ!
সব আহ্বান, সতর্কীকরণকে তুড়ি মেরে ছোট হাসপাতাল থেকে তথাকথিত বড় হাসপাতালে নির্বিচারে রোগী ‘রেফার’ করাটাই এ রাজ্যে রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। এক শ্রেণির সরকারি চিকিৎসকের যুক্তিহীন রেফারের প্রবণতায় প্রাণসংশয় হচ্ছে বহু রোগীর। অথচ রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে তৎক্ষণাৎ রেফারের পরিবর্তে তাকে স্থিতিশীল করে ‘বড়’ জায়গায় পাঠানোটা যে আক্ষরিক অর্থেই জীবনদায়ী হয়ে উঠতে পারে, অনেক চিকিৎসকই তা বুঝতে পারেন না, কিংবা বুঝলেও করেন না বলে অভিযোগ।
এই সত্যিটাই এ বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের একটি ঘটনা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য হল উল্টোটা। মেদিনীপুর মেডিক্যাল এবং কলকাতার এসএসকেএমের যুগ্ম প্রয়াস বাঁচিয়ে দিল এক কিশোরের প্রাণ। |
কালীপুজোর রাতে গাছের মগডাল থেকে পড়ে চোদ্দো বছরের ছেলেটির লিভার ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল পুরো শরীর। বাড়ির লোক তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। যেখানে পৌঁছে পরিজনেরাই ডাক্তারদের মিনতি করে বলেছিলেন, “পিজি-তে রেফার করে দিন। পারলে ওখানকার ডাক্তারবাবুরাই পারবেন।”
ওঁরা জেলা হাসপাতালের উপরে ভরসা রাখতে পারেননি। রেফারেল ব্যবস্থাকে যুক্তিযুক্ত করে তোলার পথে আমজনতার যে মানসিকতাও বড় বাধা বলে ইতিমধ্যে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য-কর্তা ও চিকিৎসকেরা। এবং এ ক্ষেত্রে এটা মেদিনীপুর মেডিক্যালের ডাক্তারদের সামনেও দায় এড়ানোর ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হয়ে উঠতে পারত।
কিন্তু এখানেই ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল।
মরণাপন্ন ছেলেটিকে চটজলদি রেফার না-করে তাকে আপাদমস্তক পরীক্ষা করেছিলেন ওখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। বুঝেছিলেন, বিনা চিকিৎসায় ছেড়ে দিলে কলকাতায় পৌঁছনোর আগেই সে মারা যাবে। এ-ও বুঝেছিলেন, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করাটাই সবচেয়ে জরুরি। করলেনও। কী চিকিৎসা?
প্রথমেই ছেলেটির পেট কেটে কয়েক টুকরো হয়ে ঝুলতে থাকা লিভারটি সেলাই করলেন তাঁরা। একাধিক তুলোর প্যাড গুঁজে বন্দোবস্ত হল রক্তক্ষরণ ঠেকানোর, ডাক্তারি-পরিভাষায় যার নাম ‘পেরি হেপাটিক প্যাকিং।’ অত্যধিক রক্তপাতে মুমূর্ষু কিশোরকে চার বোতল রক্তও দেওয়া হল।
পর দিন সকালে দেখা গেল, রোগীর অবস্থা তুলনায় স্থিতিশীল। তখন তাকে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে পাঠানো হল এসএসকেএমে। যেখানে রোগীর সিটি স্ক্যান-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। তার পরে ফের আর এক দফা অস্ত্রোপচার।
এত সবের পরে ঝাড়গ্রাম থানার দেনাগড়ের কিশোর চন্দন দাস আপাতত সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত।
রাজ্যের প্রথম সারির সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমের শল্য চিকিৎসকেরা অবশ্য কৃতিত্বের সিংহভাগটাই দিতে চেয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যালের কয়েক জন তরুণ ডাক্তারকে। যাঁরা ঠিক সময়ে একটা ছোট্ট কাজ করেছিলেন বলেই চন্দন স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছিল। তা না-করে ছেলেটিকে তৎক্ষণাৎ পিজি-তে রেফার করা হলে কলকাতায় আসার পথেই তার মৃত্যু হতো বলে কলকাতার চিকিৎসকেরা মোটামুটি নিশ্চিত।
বস্তুত স্থানীয় সূত্রেও জানা যাচ্ছে, মেদিনীপুর মেডিক্যালের তরুণ চিকিৎসকেরা ওখানকার বাসিন্দাদের বড় ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ওই হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীর বক্তব্য, যা পরিষেবা তাঁরা পান, তা মূলত তরুণ ডাক্তারদেরই মেহনতের ফসল। চন্দনের যে পরিজনেরা তাকে পিজি-তে রেফার করতে ডাক্তারদের অনুরোধ করেছিলেন, এখন তাঁরাও বুঝছেন, কী সাংঘাতিক ভুল করতে চলেছিলেন।
চন্দনের বাবা রাজু দাস এখন তাই মানছেন, “আমরা সব সময়ে কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। এ জন্য ছেলেটার প্রাণ চলে যেতে পারত! এখানকার ডাক্তারবাবুদের জন্য বেঁচে গেল।” এসএসকেএমের শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের মন্তব্য, “আকছার এমন সব রোগী আমরা পাই, জেলা হাসপাতালগুলো যাঁদের ন্যূনতম চিকিৎসা না-করে রেফার করে দেয়। এতটা পথ আসতে আসতেই তাঁরা মারা যান। চিকিৎসাবিদ্যার ন্যূনতম প্রয়োগও বহু ডাক্তার করেন না। এর ব্যতিক্রম হয়েছে বলেই চন্দন বেঁচে গিয়েছে। ”
মেদিনীপুর মেডিক্যালের যে তরুণ মেডিক্যাল অফিসার তরুণতর কয়েক জন চিকিৎসককে সঙ্গী করে চন্দনকে ‘নতুন জীবন’ দিলেন, সেই মৃত্যুঞ্জয় পাল কী বলছেন?
মৃত্যুঞ্জয়বাবু জানাচ্ছেন, চন্দনের কেস যখন তাঁদের কাছে আসে, তখন গভীর রাত। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বা অন্য কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়নি। ‘ক্লিনিক্যালি’ দেখেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কথায়, “গোড়াতেই বুঝে গিয়েছিলাম, লিভার সার্জারির পরিকাঠামো রয়েছে, এমন কোথাও ছেলেটাকে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে এসএসকেএমই ওর গন্তব্য। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমাদের। আমরা শুধু সেটাই পালন করেছি।”
স্বাস্থ্যকর্তারাও বলছেন, পেশায় প্রবেশের মুহূর্তে যে শপথবাক্য ডাক্তাররা আওড়ান, মৃত্যুঞ্জয়বাবুরা সেটাই করেছেন। কিন্তু এ রাজ্যে সেটাই যে ব্যতিক্রম! |